প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও কমলা লেবুর দেশে দুই দিন

- আপডেটের সময় : ১০:৩৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫
- / ১৭০ টাইম ভিউ
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ও লেবুর দেশে দুই দিন
চন্দ্রানী চন্দ্রা।
হাওর- পাহাড়, ঝর্ণা প্রকৃতি ঘেরা সিলেট। যতদূর চোখ যাবে পাহাড় টানবে। সেই সাথে প্রশান্তি মনে প্রাণে। ২০২৫ এ মে মাসের শুরুতে ঘুরতে গেলাম সিলেটে। যেখানে লন্ডনীদের বাস। যারা সিলেটি ছাড়া শুদ্ধ বাংলা কম বলতে পারে, এর মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে সিলেটের একটি রিলস ভাইরাল । আমি শুদ্ধ বাংলা বলতে পারিনা, সিলেটি মাততাম পারি। যা হোক মে দিবসের একদিন পর জয়ন্তিকা ট্রেনে ঢাকা থেকে রওনা দিলাম সিলেটে। সকাল ১১.১০ এর ট্রেন আসলো ১২টা ১০ মিনিটে। সিট আগে থেকে বুকিং থাকায় বেগ পেতে হয়নি। এর পর হুইসেল বাজিয়ে ঝমঝম আওয়াজ তুলে রেলের ছুটে চলা। ইট পাথরের ব্যস্ত নাগরিক জীবন পেছনে ফেলে ট্রেন চলছে।
মাঝ পথে কুলাউড়া নেমে পড়লাম, স্টেশনের কাছে ছিলো হোটেল। একটা মাকের্টের ওপরে, শুক্রবার মার্কেট বন্ধ ছিলো। চাবি নিয়ে কলাপসিবল গেইট খুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন, হোটেলের এক কর্মকর্তা। আমরা ঢোকার পর আবার তালা লাগিয়ে দিলেন, মার্কেটের নিরাপত্তার কারণে।
যা হোক হোটেলে গিয়ে হাত পা ছাড়িয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম আমরা। সন্ধ্যা ৭ টা বাজে, সবাই তৈরি হলাম, বেরুবো। খাওযা দাওয়া করতে যাবো পর্তুগালের এক ভাইয়ের বাসায়। তার আগে একটু কূলাউড়া ঘুরে দেখতে বেরুলাম, রাস্তায় দেখি চটপটি,ফুচকা বিক্রি হচ্ছে। আমরা খেতে লাগলাম।
এরমধ্যে পর্তুগালের ভাই চলে আসলো বাসায় নিয়ে যেতে। সেখানে দেখা হলো দুবাইয়ের এক ভাইয়ের সাথে। প্রথম দিনে সেই রাতে ছিলো ভাবীর হাতের রান্নার কয়েক পদ আয়োজন ছিলো। খাওয়া দাওয়া ও চায়ের আড্ডায় রাত ১২ টা পর্যন্ত চললো। এর পর ঘুমাতে আবারো ফিরে গেলাম হোটেলে।
পরদিন সকাল ১০টা দিকে গাড়ি হোটেলের সামনে । কুলাউডার টিপু ভাই ও তার মেয়ে, আমি, আমার মা আর চিটাগাংয়ের আংটি একসাথে বেরিয়ে পড়লাম মাধবকুণ্ড ও লাউয়াছড়ায় উদ্দেশ্যে। গাড়ি চালাচ্ছে ইমরান, সে লোকাল পত্রিকায় স্পোটর্স সাংবাদিক। পরে অবশ্য স্টিয়ারিং বদল হলো, মাধবকুন্ড পর্যন্ত চালালেন টিপু ভাই। বেশ হাসি আনন্দে গানে গাড়িতে ভ্রমন আমাদের।
যা হোক গাড়ি ছুটছে, চা বাগান, পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যেতে থাকলাম মাধবকুন্ড জলপ্রপাতের দিকে। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত।
কুলাউড়া উপজেলা থেকে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর,এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হাকালুকি হাওর এবং চা বাগান দেখে দেখে জুড়ী উপজেলা হয়ে বড়লেখায় বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত মাধবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে যাই। কুলাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে কাঁঠালতলী এলাকার পাথারিয়া পাহাড়ে অবস্থিত এই মায়াবী জলপ্রপাত। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতটি বাংলাদেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত। প্রায় ২০০ ফুট উঁচু টিলা হতে পাহাড়ি ঝর্নার পতিত জলরাশি পর্যটকের জন্য আকর্ষণীয়। এ জলপ্রপাতের নিকটেই খাসিয়া নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। জলপ্রপাতের চতুর্দিকে বিশাল বনভূমি অবস্থিত। মাধবকুন্ড ইকোপার্কে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটকের সমাগম ঘটে। তাছাড়া এ মাধবকুন্ড জলপ্রপাত সংলগ্ন কুন্ডে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চৈত্রমাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে বারুনী স্নান হয় এবং মেলা বসে।
একই রাস্তায় কুলাউড়া উপজেলা থেকে কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়া। এখানে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য্য ভান্ডার অকৃপণভাবে বিতরণ করেছে। বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, বিচিত্র রকমের বন্য প্রাণী যেমন হরিণ, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বন মোরগ, মেছো বাঘ দেখতে পাওয়া যায়।
জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ ছবিটির একটি দৃশ্যের শূটিং হয়েছিলো এই বনে। বন ঘেঁষে যে রেলপথ চলে গেছে, ঠিক সেখানেই হয়েছিলো ছবিটির কিছু দৃশ্যের শুটিং। ছবিটির একটি দৃশ্য ছিলো এ রকম- ট্রেন ছুটছে। হঠাৎ চালক খেয়াল করলেন, লাইনের সামনে একপাল হাতি আপনমনে চড়ে বেড়াচ্ছে। ট্রেন থেমে যায়। কামরা থেকে নেমে আসেন ডেভিড নিভেন, ব্যাপারটা কী দেখতে। সামনের গ্রামেই তখন হচ্ছিল সতীদাহ। নায়ক ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে বাঁচান। মেয়েটি হলো শার্লি ম্যাক্লেইন। ছবির এই অংশটুকুই চিত্রায়িত হয়েছিলো লাউয়াছড়ার রেললাইন এলাকায়। হুমায়ুন আহমেদের আমার আছে জল- এর শুটিং হয়েছে এই লাউয়াছড়ায়।
এছাড়া বাংলাদেশের একমাত্র জীবিত আফ্রিকান টিকওক গাছটি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আছে। লাউয়াছড়া উদ্যানেই বেশি সংখ্যায় উল্লুক দেখা যায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে বনরুই,অজগর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ প্রায় ২৭৬ প্রজাতির বন্যপ্রাণী আছে। এই উদ্যানের ভিতরে রয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী খাসিয়াপুঞ্জি, যারা ধারণ করে আছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভিতরে রয়েছে এক,দেড় ও তিন ঘন্টার তিনটি ট্রেইল, যেখানে পর্যটকরা প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করতে পারে। তিন ঘন্টার হাঁটা পথটিও বেশ রোমাঞ্চকর।
লাউয়াছড়া থেকে বেরিয়ে গেলাম চা এর রাজধানী শ্রীমঙ্গলে। চা-পাতার ঘ্রান সাত লেয়ারের চা পান করে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। উপজেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান কুলাউড়া উপজেলায় বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হাওর,এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হাকালুকি হাওর এবং চা বাগান দেখে মন জুড়িয়ে গেলো। শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেট উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। দুঃখের বিষয় হলো মাধবকুন্ড , বড়লেখা, শ্রীমঙ্গল, লাউয়াছড়া দেখতে গিয়ে ৫.৩০ এর সিলেটগামী ট্রেন মিস করি। এর পর রাত ১০.৩০ এর ট্রেনে উঠে পড়ি, টিটিকে ম্যানেজ করে সিলেটে পৌঁছে যাই রাত সাড়ে ১১টায়।
আগেই গ্লোডেন সিটি হোটেলে বুকিং করাই ছিলো। ঘোরার জন্য ১৫ শ’ টাকায় সিএনজি ম্যানেজ করি রাতার গুল ও সাদা পাথরের পাহাড়, চা বাগান দেখার জন্য। বিখ্যাত পাঁচ ভাইয়ের হোটেলে খেতে গেলাম, ১০ রকমের বিভিন্ন রকম ভর্তা, বেগুন ভাজি দিয়ে খেতে মজাই লাগলো।
পরদিন সকালে সিএনজি এসে হাজির। রৌদ উজ্জ্বল সুন্দর সকালে, রাতারগুল দেখতে বেরিয়ে পরলাম। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত দেশের একমাত্র স্বীকৃত সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলার বন রাতারগুল যা বাংলার অ্যামাজন নামে পরিচিত। সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে রাতারগুলের অবস্থান। বনের ৮০ শতাংশ এলাকাই গাছ দিয়ে ভরা। পরে ছোট ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে ঘুরতে যাই। মাঝির গান শুনে ভিডিও ছবি তুলে বেশ উপভোগ করি। ভারতরে মেঘালয়ের জলধারা গোয়াইন নদীতে এসে পড়ে আর সেখানকার এক সরু শাখা চঙ্গেী খাল হয়ে পানিতে পরিপূর্ণ, প্লাবতি হয়ে পুরো রাতারগুল জলাবন। মে থেকে সেপ্টেম্বর র্বষা মৌসুমরে প্রায় সবসময়ই পানি থাকে বনে । শীতকালে অবশ্য ছোট হয়ে যায় বন, পাতা ঝরা শুষ্ক ডাঙ্গায় পরিণত হয়। আর ছোট ছোট খালগুলো হয়ে যায় পায়ে চলা মঠেোপথ। আর তখন জলজ প্রাণীকুলরে আশ্রয় হয় বন বিভাগের বড় বড় ডোবাগুলোত।
রাতারগুলের পর ঘোরার পর যাই সাদা পাথর ভ্রমণে। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই অঞ্চলটি স্থানীয় ও ভ্রমণকারীদের জন্য প্রিয় এক গন্তব্য। অনেকেই সাদা পাথরের উপর বসে গা জ্বালিয়ে সূর্যাস্তের রং বদলানোর দৃশ্য দেখেন। কেউ সাদা পাথর থেকে পানির মধ্যে পাথর ছুঁড়ে দেয়ার আনন্দ নেন, আবার অনেকেই পাথরের ছোট পিরামিড বানিয়ে নিজেদের ছবি তোলেন।
ভোলাগঞ্জ থেকে সাদা পাথর অঞ্চলে যাওয়ার জন্য নৌকায় যাত্রা করতে হয়, কারণ ভোলাগঞ্জের এই এলাকাটি ধলাই নদীর তীরে অবস্থিত। আর সাদা পাথর এলাকায় সরাসরি হাঁটা পথ নেই। নদীর পানি ও প্রবাহিত জলরাশিই একমাত্র মাধ্যম, নৌকা থেকে নেমে সাদা পাথরে মূল এলাকায় যেতে অনেকে ঘোড়ায় উঠে পড়ে। আমরা ও ঘোড়ায় চড়ে গেলামা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর সাদা পাথরে দেখলে মনে হবেই জল, পাথর আর বুনো সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসেন শত শত ভ্রমণপ্রেমী।
বর্ষাকালে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে সাদা পাথরের অঞ্চল হাঁটার জন্য অপ্রতুল ও অসম্ভব হয়ে যায়। তবে নদীর পানি বেড়ে গেলে এখানে নৌকায় চড়ে ভ্রমণ আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে।
ভোলাগঞ্জের স্থানীয় লোকজন জীবিকা নির্বাহ করে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে। এটি সিলেটের পাথর শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখে। পাথর উত্তোলনের কাজ কঠিন হলেও এখানকার মানুষ এ কাজের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই সম্পৃক্ত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও পর্যটকদের জন্য বেশ কৌতূহলের।
সিলেটের সাদা পাথর অঞ্চল প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক মোহনীয় স্থান। সেখানকার স্বচ্ছ পানি, সাদা পাথর ও সবুজ পাহাড়ের সম্মিলিত সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করে রাখে দীর্ঘদিন।
চন্দ্রানী চন্দ্রা।