ঢাকা , শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আপডেট :
যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস পালন করেছে দূতাবাস রোম পর্তুগাল জাসাসের আলিসবনে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস পালিত বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল মিলানের আয়োজনে মহান বিজয় দিবস পালিত মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা করেছে সম্মিলিত নাগরিক কমিটি ভেনিস বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মনফালকনে গরিঝিয়া শাখা ইতালির আয়োজনে বাংলাদেশের ৫৩ তম বিজয় দিবস উদযাপন ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত রোমে সিলেট বিভাগ জাতীয়তাবাদী যুবদল গঠন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলা প্রবাসীদের নিয়ে পঞ্চগ্রাম প্রবাসী উন্নয়ন ফোরামের ৭৭ বিশিষ্ট কমিটি গঠন সুয়েব এবং রুবিয়াত আফরিনা ১৮তম বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন করেছেন অ্যামাজন জঙ্গলে কুলাউড়া বিএনপির দীর্ঘ যুগ পর কোন্দলের অবসান। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার অঙ্গীকার

আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন শাহ সূফী মাও: আব্দুর রহিম তফাদার (রহ:)

নিউজ ডেস্ক
  • আপডেটের সময় : ১১:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০
  • / ২৭৪৭ টাইম ভিউ

উস্তাজুল উলামা খলিফায়ে বিশকুটি শাহ সূফী মাও: আব্দুর রহিম তফাদার (রহ:) মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন।

মানবতার মুক্তির দিশারী, সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) বলেন, মানুষ যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় তখন তার নেক আমলের (ভাল কাজের মাধ্যমে সাওয়াব অর্জন) দরজা (পথ) বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটির মাধ্যমে মানুষ কবর থেকেও নেক আমল করতে পারে। এগুলো হচ্ছে-
ক. সাদকায়ে জারিয়াহ অর্থাৎ নিজের সম্পদ ব্যয় করে এমন কিছু কাজ করা যা স্থায়ী থাকবে এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।
খ. উপকারী ইলিম অর্থাৎ মানুষের জ্ঞান বিতরণ করা যা পরবর্তী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে।
গ. নেক সন্তান অর্থাৎ নিজের সন্তানদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যাতে তারা ভাল ও কল্যাণকর কাজ করে এবং তাঁর পিতা মাতার জন্য দোয়া করে।

আমাদের সমাজে এমন কিছু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের জন্ম হয় যারা উল্লিখিত তিনটি কাজই করেছেন এবং এর মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও কবরে সওয়াব পাচ্ছেন আবার ভাল কাজের ফলস্বরুপ মানুষের কাছেও অমর হয়ে আছেন। এমনই এক মহাপুরুষ ছিলেন শাহ সূফি মাওলানা আব্দুর রহিম তফাদার (রহ.)। যিনি তার জীবনেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছিলেন শিক্ষকতার মহান পেশায়। অসহায়, গরীব, দুঃখী, এতিম শিশুদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মতো মানবসেবাও তিনি নিজ অভিভাবকত্বে করে গেছেন। যার জ্ঞান বিতরণে আলোকিত হয়েছে অসংখ্য আদম সন্তান। দেশ বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে কর্মরত আছেন উনার অসংখ্যা ছাত্র-ছাত্রীরা। নিজের অর্জিত জ্ঞানকে যিনি প্রবাহিত করে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, যা প্রবাহিত হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন আধ্যাত্মিকতার মহান খেদমত। স্বীয় পীর ও মুরশিদের কাছে তরিকতের বায়য়াত গ্রহণ করে পেয়েছেন প্রথম খেলাফত। পীর ও মুরশিদ আল্লামা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বিশকুটি (রহ:) এর সহযোগীতায় প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ ও এতিমাখানা।

শাহ সূফী মাওলানা আব্দুর রহিম তফাদার (রহ:) অবিভক্ত ভারতের খাছাড় জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার লিলাম বাজার থানার বাটইয়া গ্রামের এক সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৯ সালের ১৬ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মুন্সী মোঃ মনোহর আলী তফাদার ও মাতা মরহুমা মোছাঃ আছিয়া খাতুন। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি লিলাম বাজার থানার গান্দাই বাজার মাদ্রাসা থেকে ১৯৫২ সালে দাখিল (মাধ্যমিক) পাশ করেন। অতঃপর পাথার কান্দি থানার বিখ্যাত আছিমগঞ্জ সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৪ সালে আলিম (উচ্চ মাধ্যামিক) পাশ করেন। ভারত বর্ষের বিখ্যাত রামপুর কামিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৬ সালে হাদীস বিভাগে ফাযিল (ডিগ্রী) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রী লাভ করেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৫৮ সালে ফিকাহ বিভাগে কামিল (মাস্টার্স) পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি তাফসীর ও হাদীস বিভাগেও কামিল ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ছাত্র জীবন থেকে আরবি, উর্দূ ও ফার্সি ভাষায় খুব পারদর্শী ছিলেন এবং অনেক ইসলামিক কিতাবাদিও লিখেছেন। লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করে তিনি শিক্ষকতার মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরু ১৯৫৮ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্ম নগর থানার বাগন ইসলামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তিনি এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর দক্ষতা ও আন্তরিক পরিশ্রমে মাদ্রাসাটি প্রভ‚ত উন্নতি সাধন করে। অল্প দিনের মধ্যেই মাদ্রাসাটি টাইটেল স্তরে উন্নীত হয়।

ষাটের দশকে তিনি ধর্ম নগর এলাকা থেকে ৭৬ জন সফর সঙ্গী নিয়ে প্রথম হজ্জব্রত পালন করতে যান।
তিনি একজন যোগ্য অভিভাবকও ছিলেন। উনার প্রচেষ্টায় ছোট ভাই মাওলানা আব্দুল হামিদ তফাদার সাহেবও ১৯৬৯ সালে সৎপুর কামিল মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি ভাইকেও শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করান। বাকি ভাইবোনদেরকে তিনি সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক করে গড়ে তোলেন।

তিনি ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন সিলেট জেলার কুলাউড়া থানার গুপ্তগ্রামে স্থায়ী নিবাস গড়েন। ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারি উনার পীর ও মুরশিদকে নিয়ে হিঙ্গাজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পর্যায়ক্রমে দাখিল ও আলিম স্তরে উন্নীত হয়ে বর্তমানে ফাযিল পর্যন্ত পাঠদান চলছে। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাদরাসাটি অল্প দিনের মধ্যেই মৌলভীবাজার জেলার মধ্যে অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি অধ্যক্ষ থাকা কালিন বার বার জেলা ও বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক/শ্রেষ্ঠ মাদরাসা প্রধান হিসেবে পুরষ্কার লাভ করেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালীন অবস্থায় ১৯৯৯ সালেই ১৬ই নভেম্বর চাকুরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

একজন আদর্শ শিক্ষক ছাড়াও তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী। কাদিপুর ইউনিয়নের গুপ্তগ্রামে স্বীয় বাড়ির পাশে তিনি নিজামিয়া বিশকুটি এতিমখানা, নিজামিয়া বিশকুটি দাখিল মাদ্রাসা ও গুপ্তগ্রাম (শরীফপুর) জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। হিঙ্গাজিয়া এলাকার আশপাশের মসজিদগুলো প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিরাট ভ‚মিকা ছিল। ভারতের ধর্মনগর, করিমগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদ প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। শিক্ষকতা থেকে অবসরের পর তিনি সবসময় তাঁর মুর্শিদ আল্লামা ছাহেব কিবলাহ্ বিশকুটি (রহ:) এর সান্নিধ্যে কাঠাতেন। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিল ও খানকাহ পরিচালনা করতেন। কর্মব্যস্ত জীবনে যখনই সময় পেতেন তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তক, তাসবীহ-তাহলীল পাঠে নিয়োজিত থাকতেন। তিনি সবসময় মানুষকে কোমল ভাষায় সৎ উপদেশ প্রদান করতেন। তাঁর ব্যবহারে যে কেউ মুগ্ধ হতো। শেষ জীবনে তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর মাজার শরীফে কাঠাতেন। শেষ রাতে তিনি আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য ইবাদত বন্দেগী ও মুরাকাবায় ব্যস্ত থাকতেন। প্রচুর পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। অলসতা বা আলাস্য তাঁকে কখনও হার মানাতে পারেনি। জীবনে অনেকবার হজ্জ ও উমরাহ করেছেন। ভারত ও বাংলাদেশের অসংখ্য ওলী আউলিয়াদের মাজার যিয়ারতও করেছেন।

শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন আদর্শ পিতা। তাঁর সব সন্তানকেই গড়ে তুলেছেন আদর্শ মানব ও যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে। পারিবারিক দিক থেকে তিনি সাত সন্তানের জনক। তারা সকলেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মোঃ আবুল কালাম (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার) নিজামিয়া বিশকুটি এতিমখানার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাছাড়া তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দি¦তীয় ছেলে এ কে এম শামছুল ইসলাম সাউথইষ্ট ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তৃতীয় ছেলে মাওলানা আবু নছর মোহাম্মদ কুতুবুজ্জামান আমেরিকার মিশিগান হেন্টামিক জামে মসজিদের খতিব ও আল ইসলাহ ইসলামিক সেন্টারের প্রিন্সিপাল। প্রবাসে যাওয়ার পূর্বে তিনি বাদে দেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসার প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চতুর্থ ছেলে মাওলানা আবু সালেহ মোহাম্মদ কুতুবুল আলম সিলেট শাহজালাল দারুসসুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল ও বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের কারিকুলাম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথম জামাতা হাফিজ মাওলানা তারিকুল ইসলাম হাসিমপুর আহমদিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। দ্বিতীয় জামাতা মাওলানা আব্দুস শাকুর মানিকোনা দাখিল মাদরাসার সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তৃতীয় জামাতা মাওলানা আব্দুল মুন্তাকিম হিঙ্গাজিয়া সিনিয়র মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মাওলানা আব্দুর রহিম তফাদার (রহ.) ৩রা মার্চ ২০১৬ইং বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৭.০০ ঘটিকার সময় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে মহান মাওলার সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। তিনি স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী, ভাই-ভাতিজা, ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী ও এলাকাবাসীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান। পরদিন শুক্রবার (৪ঠা মার্চ) সকাল ১১.০০ ঘটিকায় তাঁর জানাযার নামাজ সম্পন্নের পর তাঁর বাড়ির সম্মুখের পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন।

প্রতি বছর ৩রা মার্চ সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মরহুমের জীবনী আলোচনা, বিভিন্ন খতম, তরিকতের আলোচনা, ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ ও দোয়ার মাধ্যমে ঈসালে সাওয়াব পালন করা হয়। অসংখ্য মানুষ উনার মাজার যিয়ারত করতে আসেন। এছাড়াও কবরের পাশে সর্বক্ষণিক কুরআন তিলায়ত করছে অসংখ্য ছাত্র ও এতিম নিবাসীরা। যাহা হয়তো তিনি কবর থেকে শুনতে পাচ্ছেন। আল্লাহ তাঁর ইলমে দ্বীনের এ খাদেমকে যেন জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন। আমিন!

লেখক: মাওলানা মোঃ তফজ্জুল ইসলাম,
সুপার-নিজামিয়া বিশকুটি দাখিল মাদ্রাসা।

পোস্ট শেয়ার করুন

আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন শাহ সূফী মাও: আব্দুর রহিম তফাদার (রহ:)

আপডেটের সময় : ১১:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০

উস্তাজুল উলামা খলিফায়ে বিশকুটি শাহ সূফী মাও: আব্দুর রহিম তফাদার (রহ:) মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন।

মানবতার মুক্তির দিশারী, সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) বলেন, মানুষ যখন পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় তখন তার নেক আমলের (ভাল কাজের মাধ্যমে সাওয়াব অর্জন) দরজা (পথ) বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটির মাধ্যমে মানুষ কবর থেকেও নেক আমল করতে পারে। এগুলো হচ্ছে-
ক. সাদকায়ে জারিয়াহ অর্থাৎ নিজের সম্পদ ব্যয় করে এমন কিছু কাজ করা যা স্থায়ী থাকবে এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।
খ. উপকারী ইলিম অর্থাৎ মানুষের জ্ঞান বিতরণ করা যা পরবর্তী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে।
গ. নেক সন্তান অর্থাৎ নিজের সন্তানদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যাতে তারা ভাল ও কল্যাণকর কাজ করে এবং তাঁর পিতা মাতার জন্য দোয়া করে।

আমাদের সমাজে এমন কিছু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের জন্ম হয় যারা উল্লিখিত তিনটি কাজই করেছেন এবং এর মাধ্যমে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও কবরে সওয়াব পাচ্ছেন আবার ভাল কাজের ফলস্বরুপ মানুষের কাছেও অমর হয়ে আছেন। এমনই এক মহাপুরুষ ছিলেন শাহ সূফি মাওলানা আব্দুর রহিম তফাদার (রহ.)। যিনি তার জীবনেই অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছিলেন শিক্ষকতার মহান পেশায়। অসহায়, গরীব, দুঃখী, এতিম শিশুদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার মতো মানবসেবাও তিনি নিজ অভিভাবকত্বে করে গেছেন। যার জ্ঞান বিতরণে আলোকিত হয়েছে অসংখ্য আদম সন্তান। দেশ বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে কর্মরত আছেন উনার অসংখ্যা ছাত্র-ছাত্রীরা। নিজের অর্জিত জ্ঞানকে যিনি প্রবাহিত করে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে, যা প্রবাহিত হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি আঞ্জাম দিয়েছেন আধ্যাত্মিকতার মহান খেদমত। স্বীয় পীর ও মুরশিদের কাছে তরিকতের বায়য়াত গ্রহণ করে পেয়েছেন প্রথম খেলাফত। পীর ও মুরশিদ আল্লামা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বিশকুটি (রহ:) এর সহযোগীতায় প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ ও এতিমাখানা।

শাহ সূফী মাওলানা আব্দুর রহিম তফাদার (রহ:) অবিভক্ত ভারতের খাছাড় জেলার করিমগঞ্জ মহকুমার লিলাম বাজার থানার বাটইয়া গ্রামের এক সম্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৩৯ সালের ১৬ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মরহুম মুন্সী মোঃ মনোহর আলী তফাদার ও মাতা মরহুমা মোছাঃ আছিয়া খাতুন। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি লিলাম বাজার থানার গান্দাই বাজার মাদ্রাসা থেকে ১৯৫২ সালে দাখিল (মাধ্যমিক) পাশ করেন। অতঃপর পাথার কান্দি থানার বিখ্যাত আছিমগঞ্জ সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৪ সালে আলিম (উচ্চ মাধ্যামিক) পাশ করেন। ভারত বর্ষের বিখ্যাত রামপুর কামিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৫৬ সালে হাদীস বিভাগে ফাযিল (ডিগ্রী) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রী লাভ করেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯৫৮ সালে ফিকাহ বিভাগে কামিল (মাস্টার্স) পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি তাফসীর ও হাদীস বিভাগেও কামিল ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি ছাত্র জীবন থেকে আরবি, উর্দূ ও ফার্সি ভাষায় খুব পারদর্শী ছিলেন এবং অনেক ইসলামিক কিতাবাদিও লিখেছেন। লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করে তিনি শিক্ষকতার মহান পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের শুরু ১৯৫৮ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্ম নগর থানার বাগন ইসলামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তিনি এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর দক্ষতা ও আন্তরিক পরিশ্রমে মাদ্রাসাটি প্রভ‚ত উন্নতি সাধন করে। অল্প দিনের মধ্যেই মাদ্রাসাটি টাইটেল স্তরে উন্নীত হয়।

ষাটের দশকে তিনি ধর্ম নগর এলাকা থেকে ৭৬ জন সফর সঙ্গী নিয়ে প্রথম হজ্জব্রত পালন করতে যান।
তিনি একজন যোগ্য অভিভাবকও ছিলেন। উনার প্রচেষ্টায় ছোট ভাই মাওলানা আব্দুল হামিদ তফাদার সাহেবও ১৯৬৯ সালে সৎপুর কামিল মাদ্রাসা থেকে কামিল পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি ভাইকেও শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করান। বাকি ভাইবোনদেরকে তিনি সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক করে গড়ে তোলেন।

তিনি ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন সিলেট জেলার কুলাউড়া থানার গুপ্তগ্রামে স্থায়ী নিবাস গড়েন। ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারি উনার পীর ও মুরশিদকে নিয়ে হিঙ্গাজিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পর্যায়ক্রমে দাখিল ও আলিম স্তরে উন্নীত হয়ে বর্তমানে ফাযিল পর্যন্ত পাঠদান চলছে। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাদরাসাটি অল্প দিনের মধ্যেই মৌলভীবাজার জেলার মধ্যে অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তিনি অধ্যক্ষ থাকা কালিন বার বার জেলা ও বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক/শ্রেষ্ঠ মাদরাসা প্রধান হিসেবে পুরষ্কার লাভ করেন। উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালীন অবস্থায় ১৯৯৯ সালেই ১৬ই নভেম্বর চাকুরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

একজন আদর্শ শিক্ষক ছাড়াও তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী। কাদিপুর ইউনিয়নের গুপ্তগ্রামে স্বীয় বাড়ির পাশে তিনি নিজামিয়া বিশকুটি এতিমখানা, নিজামিয়া বিশকুটি দাখিল মাদ্রাসা ও গুপ্তগ্রাম (শরীফপুর) জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। হিঙ্গাজিয়া এলাকার আশপাশের মসজিদগুলো প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিরাট ভ‚মিকা ছিল। ভারতের ধর্মনগর, করিমগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন মাদ্রাসা, মসজিদ প্রতিষ্ঠায় তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। শিক্ষকতা থেকে অবসরের পর তিনি সবসময় তাঁর মুর্শিদ আল্লামা ছাহেব কিবলাহ্ বিশকুটি (রহ:) এর সান্নিধ্যে কাঠাতেন। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিল ও খানকাহ পরিচালনা করতেন। কর্মব্যস্ত জীবনে যখনই সময় পেতেন তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় পুস্তক, তাসবীহ-তাহলীল পাঠে নিয়োজিত থাকতেন। তিনি সবসময় মানুষকে কোমল ভাষায় সৎ উপদেশ প্রদান করতেন। তাঁর ব্যবহারে যে কেউ মুগ্ধ হতো। শেষ জীবনে তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর মাজার শরীফে কাঠাতেন। শেষ রাতে তিনি আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য ইবাদত বন্দেগী ও মুরাকাবায় ব্যস্ত থাকতেন। প্রচুর পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। অলসতা বা আলাস্য তাঁকে কখনও হার মানাতে পারেনি। জীবনে অনেকবার হজ্জ ও উমরাহ করেছেন। ভারত ও বাংলাদেশের অসংখ্য ওলী আউলিয়াদের মাজার যিয়ারতও করেছেন।

শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন আদর্শ পিতা। তাঁর সব সন্তানকেই গড়ে তুলেছেন আদর্শ মানব ও যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে। পারিবারিক দিক থেকে তিনি সাত সন্তানের জনক। তারা সকলেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মোঃ আবুল কালাম (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার) নিজামিয়া বিশকুটি এতিমখানার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাছাড়া তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দি¦তীয় ছেলে এ কে এম শামছুল ইসলাম সাউথইষ্ট ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তৃতীয় ছেলে মাওলানা আবু নছর মোহাম্মদ কুতুবুজ্জামান আমেরিকার মিশিগান হেন্টামিক জামে মসজিদের খতিব ও আল ইসলাহ ইসলামিক সেন্টারের প্রিন্সিপাল। প্রবাসে যাওয়ার পূর্বে তিনি বাদে দেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসার প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চতুর্থ ছেলে মাওলানা আবু সালেহ মোহাম্মদ কুতুবুল আলম সিলেট শাহজালাল দারুসসুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল ও বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের কারিকুলাম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথম জামাতা হাফিজ মাওলানা তারিকুল ইসলাম হাসিমপুর আহমদিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। দ্বিতীয় জামাতা মাওলানা আব্দুস শাকুর মানিকোনা দাখিল মাদরাসার সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তৃতীয় জামাতা মাওলানা আব্দুল মুন্তাকিম হিঙ্গাজিয়া সিনিয়র মাদরাসার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মাওলানা আব্দুর রহিম তফাদার (রহ.) ৩রা মার্চ ২০১৬ইং বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৭.০০ ঘটিকার সময় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে মহান মাওলার সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। তিনি স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনী, ভাই-ভাতিজা, ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী ও এলাকাবাসীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান। পরদিন শুক্রবার (৪ঠা মার্চ) সকাল ১১.০০ ঘটিকায় তাঁর জানাযার নামাজ সম্পন্নের পর তাঁর বাড়ির সম্মুখের পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন।

প্রতি বছর ৩রা মার্চ সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মরহুমের জীবনী আলোচনা, বিভিন্ন খতম, তরিকতের আলোচনা, ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ ও দোয়ার মাধ্যমে ঈসালে সাওয়াব পালন করা হয়। অসংখ্য মানুষ উনার মাজার যিয়ারত করতে আসেন। এছাড়াও কবরের পাশে সর্বক্ষণিক কুরআন তিলায়ত করছে অসংখ্য ছাত্র ও এতিম নিবাসীরা। যাহা হয়তো তিনি কবর থেকে শুনতে পাচ্ছেন। আল্লাহ তাঁর ইলমে দ্বীনের এ খাদেমকে যেন জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করেন। আমিন!

লেখক: মাওলানা মোঃ তফজ্জুল ইসলাম,
সুপার-নিজামিয়া বিশকুটি দাখিল মাদ্রাসা।