অপরাজিত বীর মুক্তিসেনা মানিক ও বিজয় ‘৭১ -সুমা দাস
- আপডেটের সময় : ০২:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৯
- / ৭৯৭ টাইম ভিউ
একজন বীর আর একটি বিজয়ঃ ১৯৭১। ১৯ বছরের প্রাণবন্ত,সুদর্শন,দীর্ঘাকায়, মেধাবী এক তরুণ। নাম তাঁর মানিক বীর মুক্তিসেনা মানিক
কুলাউড়া ডিগ্রী কলেজের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র সে।সহজ-সরল তাঁর জীবন পাঠ।নিজ গ্রাম থেকে কয়েক ক্রােশ পায়ে হেঁটে বাবা-মায়ের স্বপ্ন বুকে নিয়ে প্রতিদিন তিনি কলেজে আসতেন।
তাঁর শান্ত-সৌম্য চেহারা,শিষ্ঠাচার,সময়ানুবর্তীতা,স্বল্পভাষীতা আর বিনয় সুলভ স্বভাবের জন্য সকলেই তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।আর অন্যান্য বাবা-মায়ের মতো তাঁর বাবা-মা ও স্বপ্ন দেখতেন ছেলে একদিন অনেক বড়ো মানুষ হবে।নিজে সম্মানিত হয়ে সম্মানিত করবে তাদেরকে।দেশের তখন ক্রান্তিকাল,যুদ্ধকাল অবস্থা সম্মুখে। প্রতিদিনের মতো সেদিন ও তিনি কলেজে গেলেন।মুক্তি বাহিনীর লোকজন তখন যোদ্ধা তৈরির খুঁজে বের হয়েছেন চারিদিকে।ছাত্র,শিক্ষক, কৃষক,শ্রমিক সকল শ্রেণী থেকে যোদ্ধা তৈরী হবে।শুধু প্রয়োজন এক বুক সাহস আর অদম্য দেশপ্রেম।মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়। আর কিছুই লাগবে না।সেদিন তারা সেই কলেজে আসলেন।কিছু ছাত্র লাগবে তাদের।তারা বেছে নিবেন।সেই মানিক কেই তাদের আগে পছন্দ হলো।মানিক সহ আরো কয়েকজন ছাত্র কে নিয়ে তারা যুদ্ধ প্রশিক্ষণে নিয়ে গেলেন।মানিক -এর আর বাড়ী যাওয়ার উপায় ছিলো না।তিনি যাওয়ার সময় তাঁর গ্রামের এক সহপাঠী বন্ধু কে বলে গেলেন আমার মা-বাবা কে বলো আমি দেশের জন্য যুদ্ধে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরবো।নিজের প্রাণ কে তুচ্ছ জ্ঞান করে সেদিন তারা সত্যবদ্ধ হয়েছিলেন মাতৃভূমিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করবেনই।যেমন কথা তেমন কাজ।প্রশিক্ষণ থাকাকালীন সময়ে তিনি তাঁর মা-বাবা, ভাইদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।খুব অল্প সময়ে মেধাবী এই তরুণ যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠলেন। যাই হোক এই মেধাবী তরুণ অনেকগুলো অপারেশনে সেই সময় তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে বীরত্বের সাথে সফল হয়েছিলেন।আমি সেই সব অনেক কিছুই তাঁর কাছেই শুনেছিলাম।আজ তাঁর শেষের একটি বীরত্বের কথা লিখতে চাইছি।আর এই আমি নিজের সাথে সত্যবদ্ধ এই বীর-এর কাহিনী আমি আমৃত্যু লিখেই যাবো প্রজন্মের দেয়ালে।
লাস্ট অপারেশনঃ গাজীপুর চা বাগান,কুলাউড়া। এই চা বাগানটি নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর। আজো বাগানটি অক্ষত নিজের সৌন্দর্য্যে ঐশ্বর্যবান।তাই হয়তো পাক হানাদারবাহিনীরা এই জায়গাটি পছন্দ করে নিজেদের আস্তানা গড়েছিলো। কিন্তু আমাদের বীর যোদ্ধারা প্রস্তত যেকোনো ভাবে শত্রুর এই আস্তানা গুড়িয়ে দিতে হবে।বীরেরা সেই লক্ষ্যে এগিয়ে চললেন।লক্ষ যাদের স্থির তাদের তো জয় অবশ্যম্ভাবী।পায়ে হেঁটে সেদিন তারা শমসেরনগর থেকে গাজীপুরের দিকে আসতে লাগলেন।তাদের উদ্দেশ্য গাজীপুরের পাক সেনাদের আস্তানা গুড়িয়ে দিলে কুলাউড়া শত্রুমুক্ত হবে।শুরু হলো অপারেশন – প্রচন্ড গোলাগুলি চলতে থাকলো।এক পর্যায়ে মানিক -এর সহযোদ্ধা ঘনিষ্ঠ বন্ধু শত্রুর গুলিতে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মানিক তাকে জড়িয়ে ধরেন।তখন আহত বীর যোদ্ধা বললেন, মানিক তুমি যুদ্ধ করো,আমাকে ছেড়ে দাও।মানিক এর সামনে তখন লক্ষ্য একটাই পাক সেনাদের আস্তানা সহ উড়িয়ে দেওয়া।তিনি তাঁর বন্ধুটিকে এক হাত দিয়ে তাঁর পাশে শুইয়ে ভীষণ তেজদীপ্ততায় যুদ্ধ করে গেলেন।সেদিন তাঁর মাথার ওপর দিয়ে শত্রুরগুলি লক্ষভ্রষ্ঠ হলো।তিনি বেঁচে গেলেন।দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ হলো।শত্রুর আস্তানা গুড়িয়ে দিলেন এই সব কিছু সাহসী বীর তরুণরা, যারা আসলেই যোদ্ধা হয়ে জন্ম নেননি। বিজয় হলো জাতির।জয়ের শ্লোগান দিয়ে তারা সকলেই বিজয় নিয়ে ফিরলেন বীরের বেশে।মানিক তখন তাঁর সেই আহত সহযোদ্ধা বন্ধুটিকে নিজ কাঁধে তুলে নিলেন এবং কুলাউড়া অভিমুখে তারা সকলে হাঁটতে শুরু করলেন (উল্লেখ্য যে,এই আহত মুক্তিযোদ্ধা কাকু এখনো বেঁচে আছেন।উনার বাড়ী দক্ষিন ভাগ,বড়লেখা। উনি নিজেই সেই দিনের কথাগুলো আমাদেরকে বলেছিলেন।) কুলাউড়া ফিরলেন সোনার ছেলেরা।কুলাউড়াবাসী তাদের বীর সন্তানদের কে বিজয় মালা হাতে নিয়ে বরণ করে নিলেন।কেউ কোলে তুলে নিলেন,কেউ কাঁধে তুলে নিলেন,কেউ তাদের আদর করে ছুঁয়ে দেখছিলেন।এরপর সবার বাড়ীতে বাড়ীতে খাওয়ার নিমন্ত্রণ।এমন ছেলে সোনার ছেলে,বীরযোদ্ধা ছেলে কয়জন আছে-সবার মুখে জয়গান।যাই হোক আমি সেই বীরের কথা বলছি।একটু পিছনে যাই আবার-যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মানিক এর জীবনে ভালোবাসার এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো।তাঁর প্রিয়তমা হবু স্ত্রীর সাথে দেখা হয়েছিল সেই সময়টাতে।শুধুই ভালোলাগা ছিলো।তাঁর বাবার বন্ধুর মেয়ের সাথে সেই সময়ে দেখা হয়।ভালোলাগার এক আলোলাগা আবেশ ছিলো হয়তো হৃদয়ে।তাই তো যুদ্ধ পরবর্তীকালে তিনি ভালোলাগার সেই আবেশ নিয়েই নতুন জীবন শুরু করেছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রীর সাথে।যাকে দেখেই তিনি সেদিন প্রেরণা পেয়েছিলেন সহযাত্রী হয়ে স্বপ্ন দেখার।পরবর্তীকালে মানিক শিক্ষকতা করতেন।।তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণীও একজন শিক্ষয়িত্রী ছিলেন।তাদের এক পুত্র ও এক কন্যা।শান্তিময় জীবন-যাপন ছিলো তাদের। মানিক যেমন বীর সন্তান হয়েছেন তাঁর বাবা-মায়ের, তেমনি জাতির হয়েছেন শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন।যে জাতি কে এই মানিক’দের মতো বীরেরা স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন,সেই জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে চিরদিন এই বীর সন্তানদেরকে।মানিক তাঁর পুত্র কন্যাকে ও তাদের জীবন কে আলোকিত করার জন্য সুশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।তাঁর একমাত্র পুত্র বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে’র (৩৪ তম বিসিএস ক্যাডার) অধীনে একজন রাজস্ব কর্মকর্তা।তিনি পুত্র কে নিয়ে সেই রকম স্বপ্নই দেখেছিলেন। আর তাঁর একমাত্র গর্বিত কন্যা আমি।হ্যাঁ, এই মানিক’ই আমার চিরপ্রিয়তম বাবা। আমার শুধু একটাই গর্বের পরিচয়-আমি তাঁর কন্যা।এই মহান বিজয়ের দিনে আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি আমার বীরমুক্তিযোদ্ধা বাবা সহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা’দেরকে।এই বিজয় তাই এতো অহংকারের,ভালোবাসার!
লেখিকাঃ- সুমা দাস,প্যারিস,ফ্রান্স,
কবি ও কন্ঠশিল্পী