নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে বাড়িঘর বিভিন্ন স্থাপনা ও ফসলি জমি
- আপডেটের সময় : ০১:২৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ জুলাই ২০১৭
- / ১৩৭১ টাইম ভিউ
সারা দেশে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বেড়েছে নদীভাঙন। বিভিন্ন জেলায় বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি চলে যাচ্ছে নদীতে। সহায় সম্বল হারিয়ে শত শত মানুষ অন্যের বাড়িতে, উঁচু স্থানে কিংবা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। পানিবন্দী মানুষ চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। অনেক এলাকায় ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। নৌকা দেখলেই বানভাসিরা ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন।
কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা জানান, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়ে পড়েছে নতুন নতুন এলাকা। জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৭টির ৪২ ইউনিয়নের ৫ শ’ গ্রামের ২ লক্ষাধিক পানিবন্দী মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
বুধবার বিকেলে বন্যার পানিতে ডুবে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন চিলমারী উপজেলার শাখাহাতি গ্রামের সাইদুল ইসলামের মেয়ে লাইলী বেগম (২৮) ও সদর উপজেলার সদর উপজেলার খামার হলোখানা গ্রামের পনির উদ্দিনের ছেলে হামিদুল হক (১৭)।
চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্য দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবল ¯্রােতে চিলমারী উপজেলার কাঁচকোলে ডানতীর রক্ষা প্রকল্পের ৫০ মিটার বাঁধ ও রৌমারী উপজেলার যাদুর চরে কত্তিমারী বাজার রক্ষা বাঁধ ভেঙে নতুন করে ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিলেও এসব এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ১৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জেলায় এক হাজার হেক্টর জমির আউশ, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।
সরকারিভাবে স্বল্প পরিসরে ত্রাণতৎপরতা শুরু হলেও তা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেসরকারি কোনো ত্রাণতৎপরতা চোখে পড়েনি।
সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চর ভগবতিরপুরের আমজাদ আলী জানান, ছয় দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় বউ-বাচ্চা নিয়ে নৌকায় জীবনযাপন করছি। ঘরে খাবারও শেষ হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান মেম্বাররা ১০ কেজি করে চাল দিচ্ছে তা-ও সবাই পাচ্ছে না। একই চরের আমেনা বেগম জানান, ঘরে চৌকি ভাসিয়ে কোনো রকমে একবেলা রান্না করে ছেলেমেয়েদের খাওয়াচ্ছি। খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে আমাদের।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমান উদ্দিন মঞ্জু জানান, তার উপজেলার ৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৬টির প্রায় ৬০ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত। ২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি যা বিতরণ অব্যাহত আছে।
সিভিল সার্জন ডা: এস এম আমিনুল ইসলাম জানান, চরাঞ্চলে ৯টি কমিউনিটি কিনিক তলিয়ে যাওয়ায় পাশের উঁচু জায়গায় কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। জেলার বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে ৮৭টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, জেলার বন্যার্ত মানুষের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩ শ’ মেট্রিক টন চাল, ৮ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। আরো নতুন করে ১০০ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট ও ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
স্থানী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: শফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার, সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ৭ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গাইবান্ধা সংবাদদাতা জানান, ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বৃহস্পতিবার জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গত দু’দিনে বন্যার পানিতে ডুবে সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নে বুধবার রাতে স্বপ্না খাতুন এবং গতকাল দুপুরে ফুলছড়ি উপজেলার কাবিলপুরে পিনহা নামে দু’টি শিশু মারা যায়। বন্যাকবলিত এলাকার পানিবন্দী মানুষ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সঙ্কট, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ নানা সমস্যায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট এলাকায় অব্যাহত ভাঙনে এখন বিপন্ন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত জেলার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও গাইবান্ধা সদর উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নে ১৯০টি গ্রামে ২ লাখ ১০ হাজার মানুষ বন্যায় তিগ্রস্ত হয়েছেন। ২৪১ হেক্টর জমির পাট, আউশ ধান, আমন বীজতলা ও শাকসবজি নিমজ্জিত হয়েছে। ৮১ কিলোমিটার সড়ক তিগ্রস্ত হয়েছে। ৪ উপজেলার ১২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।
সারিয়াকান্দি (বগুড়া) সংবাদদাতা জানান, সারিয়াকান্দিতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। উপজেলার কাছে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৫৭টি গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এদিকে বানভাসিদের নিয়ে একটি মহল ফায়দা হাসিলে মেতে উঠেছে। বাঁধে প্রতিটি ঘর উঠানোর জন্য তাদের ২০০-৩০০ টাকা দিতে হচ্ছে। এ ব্যাপারে উপজেলা পরিষদের মাসিক সমন্বয় সভায় কয়েকজন চেয়ারম্যান বিষয়টি উত্থাপন করলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মো: হাসিম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানকে বিষয়টি নিয়ে ত্বরিত গতিতে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন। মাসিক সমন্বয় মিটিংয়ে কাজলা ও চন্দনবাইশা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদুজ্জামান ও শাহাদত হোসেন দুলাল বলেন, সারিয়াকান্দি খাদ্য গুদামের ওসি এলএসডি প্রতিটি বস্তায় দুই-তিন কেজি চাউল কম দিচ্ছেন। অতিরিক্ত সচিব এ ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।
রানীনগর (নওগাঁ) সংবাদদাতা জানান, নওগাঁর আত্রাইয়ে ২০১৫ সালে ছোট যমুনা নদীর তীরবর্তী ফুলবাড়ী বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ বন্যায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর গত দুই বছরেও মেরামত হয়নি। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে ফুলবাড়ী ও পূর্বমিরাপুরের অসংখ্য পরিবার। যাতায়াতের জন্য নৌকাই হচ্ছে তাদের একমাত্র অবলম্বন। বর্তমানে ওই এলাকার হাজার হাজার মানুষ তাদের ফসল নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন।
মিরাপুর গ্রামের মো: আবদুল কুদ্দুস জানান, আমরা বেড়িবাঁধের ভাঙন মেরামতের জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ অনেকের কাছে ধরনা দিয়েছি। সবাই আশ্বস্ত করেন; কিন্তু আজো মেরামত না হওয়ায় বর্ষা মওসুমের আগেই সেখানে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অসংখ্য পরিবার। ভবানীপুর জি এস উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক মো: মাহাবুবুর রহমান বলেন, রাস্তাটি সংস্কার করা জরুরি।
ফুলবাড়ী গ্রামের মো: তরিকুল ইসলাম বলেন, বাঁধটি মেরামত না করায় যাতায়াতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গ্রামবাসীকে। তিনি দ্রুত বাঁধটি নির্মাণের দাবি জানান।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: মোখলেছুর রহমান বলেন, বাঁধটি সংস্কার করার জন্য রোড অ্যান্ড হাইওয়ে কর্তৃপকে জানানো হয়েছে।
পাংশা (রাজবাড়ী) সংবাদদাতা জানান, পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউপির চররামনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যেকোনো সময় নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। বুধবার বিদ্যালয়টি নৌকায় চড়ে পরিদর্শন করেছেন পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: সাখাওয়াত হোসেন। উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো: বছির উদ্দিন বলেন, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা পরিষদের সমন্বয় সভায় আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে। এ দিকে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় যেতে ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে বলে অভিভাবকেরা জানিয়েছেন।
পীরগাছা (রংপুর) সংবাদদাতা জানান, ভারত গজলডোবার সব ক’টি গেট খুলে দেয়ায় তিস্তার তীব্র স্রোত আছড়ে পড়েছে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার দু’টি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলের গ্রামগুলোতে। এর মধ্যে পূর্বশিবদেব চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি যেকোনো মুহূর্তে চলে তিস্তায় চলে যেতে পারে। শিবদেব চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: আইয়ুব আলী বলেন, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবগত করার পরেও সমাধানের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিদ্যালয়ের সহসভাপতি মো: তোজ্জামেল হোসেন বলেন, বিদ্যালয়টি রক্ষা করা দরকার।
এ ছাড়াও দু’টি ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল অনেক গ্রাম তলিয়ে গেছে। হাজার হাজার হেক্টরের ভুট্টা, পাটসহ ফসলি জমি এখন পানির নিচে। নদীর ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ ও ফসলি জমি। গত এক সপ্তাহে উপজেলার ছাওলা ও তাম্বুলপুর ইউনিয়নের অনেক জমি চলে গেছে নদীতে। হুমকির মুখে পড়েছে শিাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, কিনিক ও আবাদি জমি। ভাঙনের শিকার মানুষগুলো তাদের ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন।
নদীপাড়ের মানুষেরা জানান, প্রতিদিন তিস্তায় চলে যাচ্ছে শত শত একর আবাদি জমি, বসতভিটা ও ঘরবাড়ি। হুমকির মুখে পড়েছে একটি মাদরাসা, একটি কমিউনিটি কিনিক ও দু’টি মসজিদসহ থেতরাই, জুয়ান সদরা, পূর্ব ছাওলা, চৌমুহনীসহ ৮-১০টি গ্রাম। ছাওলা ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আব্দুল হাকিম বলেন, নদীভাঙন ছাড়াও বৃষ্টির পানিতে তার ইউনিয়নের নিচু আটটি গ্রাম তলিয়ে যাওয়ায় কয়েক হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) সংবাদদাতা জানান, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। পানিবন্দী রয়েছেন ৪০ হাজার মানুষ। কাপাসিয়া ইউনিয়নের ভাটি কাপাসিয়া আশ্রয়ন কেন্দ্রেও পানি উঠেছে। নদীতে নৌকা ভাসতে দেখলেই বানভাসিরা মনে করছেন ত্রাণ নিয়ে আসছে প্রশাসন। পানিতে ভিজে ত্রাণের জন্য ছুটে আসছেন সবাই। ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে দুই হাজার মানুষের মধ্যে।
চরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে-ফিরে দেখা গেছে, বানভাসি পরিবারগুলো উঁচু স্থানে, আশ্রয়কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধে মানবেতর জীবনযাপন করছে। চরাঞ্চলের ২১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি এবং চিকিৎসা সঙ্কটে পড়েছে বানভাসি পরিবারগুলো।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম গোলাম কিবরিয়া জানান, দুর্গতদের মধ্যে এ পর্যন্ত ২০ মেট্রিক টন চাল ও এক লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
সরিষাবাড়ী (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, সরিষাবাড়ী উপজেলায় বন্যা বেড়েই চলছে। উপজেলার আটটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচ ইউনিয়নের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সেই সাথে রয়েছে গোখাদ্যের অভাব। পানিবন্দী লোকজন জানান, এখন পর্যন্ত মেম্বার চেয়ারম্যান বা সরকারি লোকজন আমাদের খোঁজ নেননি।
পিংনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন জানান, তার ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। ৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। দুর্গত মানুষেরা তারাকান্দি-ভুয়াপুর প্রধান সড়কে আশ্রয় নিয়েছেন। রাস্তাঘাট তলিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। একই অবস্থা পোগলদিঘা, সাতপোয়া, আওনা ও কামরাবাদ ইউনিয়নের পঞ্চাশ হাজার মানুষের। সরকারি কোনো ত্রাণসামগ্রী এসব ইউনিয়নে পৌঁছেনি বলে চেয়ারম্যানরা জানান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নুরুজ্জামান বলেন, বন্যায় ৩৫ হেক্টর বীজতলা, ২৫ হেক্টর সবজি ও ৫৭০ হেক্টর জমির পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আ: হামিদ জানান, দুর্গত এলাকায় ১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।
নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় নদীতে বিলীন হওয়ার পথে ডোমার উপজেলার বড় রাউতা সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া না হলে যেকোনো মুহূর্তে বিদ্যালয়টি শালকী নদীতে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হোসনে আরা জানান, গত বছর বর্ষায় শিশু শ্রেণীর রুমটি ভেঙে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বিদ্যালয়ভবন। বার বার তাগাদা দেয়ার পরও বিদ্যালয়টি সংস্কার না করায় ঝুঁকি নিয়ে কাস করতে হচ্ছে। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হাচিনুর রহমান জানান, কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানোর পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
উপজেলা শিক্ষা অফিসার শাহজাহান মণ্ডল জানান, বিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থা একাধিকবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
মৌলভীবাজার সংবাদদাতা জানান, কাউয়াদিঘী হাওর ও কুশিয়ারী নদীর পানিতে সৃষ্ট বন্যায় দুর্ভোগে পড়েছে জেলার রাজনগর উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের হাওরপাড়ের মানুষ। উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫ ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী। গতকাল রাজনগরের বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঘরে ঘরে খাবার সঙ্কট। গ্রামীণ পথঘাট বানের পানিতে নিমজ্জিত থাকায় যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়া, বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব, বন্যায় শ্রমজীবী মানুষের কাজ বন্ধ, মজুরি না থাকায় রাজনগরের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ২৮ দিন ধরে রাজনগরে বন্যা চলছে। বন্যায় রাজনগরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমেছে। বন্ধ রয়েছে রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়ক। বন্যাকবলিতদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ পৌঁছেনি। ত্রাণ যেটুকু দেয়া হচ্ছে তা-ও দলীয় ও প্রভাবশালীদের অনুসারীরা পাচ্ছেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য সৈয়দা সায়রা মহসিন সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠনকে বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
রাজনগরে রাস্তার পাশে থাকা বন্যার্তদের ত্রাণ দেয়া হলেও হাওরের প্রত্যন্ত এলাকায় তেমন কিছু দেয়া হচ্ছে না। ফলে খাবার না পেয়ে মানুষের কষ্টের সীমা থাকছে না। মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, রাজনগরের ৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫টিই বন্যাকবলিত। এই ৫ ইউনিয়নের ৭৭টি গ্রামের ৮ হাজার ৫৯০টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ১৬০ হেক্টর কৃষিজমি নষ্ট হয়েছে। এর বিপরীতে ত্রাণ পর্যাপ্ত নয় বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
রাজনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, বন্যায় এ পর্যন্ত ১১৫ মেট্রিক টন চাল, ২ শ’ প্যাকেট বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী এবং নগদ ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা ত্রাণ পেয়েছি। মেম্বার ও চেয়ারম্যানের মাধ্যমে এগুলো বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
ইসলামপুর (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, ইসলামপুরে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহতা বেড়েই চলেছে। বন্যার পানিতে ডুবে উপজেলার পাথর্শী ইউনিয়নের বেড়ের গ্রামের আরিফ (৮) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইত্তেখার আলম বাবলু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বন্যায় উপজেলার প্রায় সব রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। সদরের সাথে সাত ইউনিয়নের সড়কযোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে নৌযোগাযোগই এ অঞ্চলের একমাত্র ভরসা।
উপজেলায় ১২ ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রায় সব এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। বেসরকারি হিসাবে বানভাসি মানুষের সংখ্যা দুই লাধিক। এসব মানুষ উঁচু রাস্তা, আশ্রয়কেন্দ্র, ব্রিজ ও ঘরের মধ্যে মাচা করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য, গো-খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির চরম সঙ্কট দেখা দিলেও এখনো প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি। নৌকা দেখলেই বানভাসিরা ছুটে আসেন ত্রাণের জন্য।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম এহেসানুল মামুন জানান, বানভাসিদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। পৌর এলাকার জন্যও ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মেহেদী হাসান টিটু জানান, ইসলামপুরে এ পর্যন্ত ৭০ মেট্রিক টন চাল ও এক লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ এসেছে। গত বুধবার চিনাডুলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম ইউনিয়নের শিং ভাঙ্গা, বামনা ও ডেবরাইপেচ এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেন। এ সময় বানভাসিরা ত্রাণ না পেয়ে ত্রাণের নৌকা ধাওয়া করেন।
লালমনিরহাট সংবাদদাতা জানান, বন্যাদুর্গত এলাকায় সাপের উপদ্রবে রাতে ঘুমাতে পারছেন না বানভাসিরা। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, লালমনিরহাটে প্রায় ৪০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দেখা দেয়ায় মূলত সাপের উপদ্রব বেড়েছে। শৌলমারী চরের আকবর মিয়া বলেন, লোকালয়ে এসে সাপ কোথাও ডিম ফোটাচ্ছে কি না, সে চিন্তায় আমরা অস্থির। সাপের দংশন এড়াতে কী করণীয়, সেটাও ঠিকমতো জানি না।
বিলুপ্ত ছিটমহল আঙ্গোরপোতা-দহগ্রাম, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গিমারী, সির্ন্দুনা, পাটিকাপাড়া ও ডাউয়াবাড়ী, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, দুর্গাপুর, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, কুলাঘাট ও কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভাণ্ডার, কাকিনা ইউনিয়নের চর এলাকার গ্রামে বন্যার পানিতে ভেসে আসা সাপ মারার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। এসব এলাকায় জোঁকের বিচরণও বেড়েছে। লালমনিরহাট সিভিল সার্জন আমিরুজ্জামান বলেন, সাপের উপদ্রব এড়াতে বন্যাকবলিত এলাকার লোকজনকে সচেতন করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলার হাসপাতাল এবং ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিমও তৎপর রয়েছে।
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, দেওয়ানগঞ্জে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: গোলাম মারুফ। বৃহস্পতিবার সকালে দেওয়ানগঞ্জে তাকে স্বাগত জানান উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন। এ সময় ডিজির সাথে ছিলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক রেজাউল করিম, জেলা কৃষি কর্মকর্তা ডা: রফিকুল ইসলাম, ডিডি হর্টিকালচার ফখরুল আলম, জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আবু হানিফ প্রমুখ। ডিজি দেওয়ানগঞ্জ ইউনিয়ন, পৌরসভা ও চুকাইবাড়ি ইউনিয়নসহ বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। পরে উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে মতবিনিময় করেন।
দেওয়ানগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ উপজেলায় ৪২৫ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।
চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ের জালালপুর ইউনিয়নে পানিবন্দী মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন। বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বেড়েই চলছে। ঘরের মধ্যে মাচা করে অথবা ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বানভাসিরা।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শাহজাদপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী এনায়েতপুর থানাধীন জালালপুর ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চল যমুনার নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বাঐখোলা, কুঠিপাড়া, ভেকা গ্রামের প্রায় এক হাজার মানুষের বাড়িঘর নদীতে চলে গেছ। তারা অন্যের বাড়িতে অথবা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ইউনিয়নের জালালপুর, পাকুরতলা, দ্বাদশপট্টি, পাড়ামোহন পুরসহ গাছপাড়া, নোসনাপাড়া ও টোকপাড়া গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ তাঁতের কাজ অথবা দিনমজুরি করে জীবনযাপন করেন। কিন্তু বন্যার পানিতে বসতভিটা ও রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বাঐখোলা, কুঠিপাড়া ও ঘাটাবাড়ি এলাকায় ২ মেট্্িরক টন চাল বিতরণ করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন জনপ্রতিনিধিরা। এ সময় ত্রাণের নৌকা দেখে বানভাসি শত শত মানুষ হাজির হন জালালপুর বাজারসংলগ্ন ঘাটে। চাল না পেয়ে অনেকেই খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন।
জালালপুর ইউপি চেয়ারম্যান হাজী সুলতান মাহমুদ বলেন, তার ইউনিয়নে সাড়ে ৬ হাজার মানুষ পানিবন্দী। তাদের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৫ টন চাল প্রয়োজন। এ পর্যন্ত আমরা ৪ মেট্রিক টন চাল পেয়েছি। দ্রুত বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানাচ্ছি।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলিমুন রাজীব বলেন, লিখিতভাবে বিষয়টি জানালে অবশ্যই অতিরিক্ত ত্রাণসহায়তা বরাদ্দ দেয়া হবে।
সূত্র: নয়াদিগন্ত