আমেরিকায় ‘নায়ক’ মৌলভীবাজারের সাইদ
- আপডেটের সময় : ০৬:০৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ জানুয়ারী ২০১৯
- / ১৪৭৩ টাইম ভিউ
দেশদিগন্ত নিউজ ডেস্ক: একজন পুলিশ সদস্যের দিকে তেড়ে আসছেন পাঁচজন মদ্যপ বলবান মানুষ। মারমুখী মানুষদের নিবৃত্ত করতে কারাতে ভঙ্গিতে হাতের লাঠি চালিয়ে যাচ্ছেন সেই পুলিশ সদস্য। এতে আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন লোকগুলো। হামলে পড়ার চেষ্টা করলেন। প্রশিক্ষিত পুলিশ সদস্য লাথি দিয়ে ফেলে দিলেন একজনকে। তারপর আরও একজনকে। এভাবে একে একে ধরাশায়ী করে ফেলেন পাঁচ আক্রমণকারীকে।
ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও চিত্রের দৃশ্য এটি। আচমকা দেখলে সিনেমার কোনো বিশেষ মুহূর্তের দৃশ্য ভেবে অনেকে ভুল করতে পারেন। তবে তা সিনেমার কোনো দৃশ্য নয়, নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনের ইস্ট ব্রডওয়ের পাতাল রেলস্টেশনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা। আর যে মানুষটা নায়কোচিত ভঙ্গিতে মারমুখী ব্যক্তিদের ধরাশায়ী করলেন, তিনি সাইদ আলী। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান পুলিশ সদস্য। দেশটির নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের একজন কর্মকর্তা।
পুলিশের একজন কর্মকর্তার দিকে মারমুখী হয়ে তেড়ে আসার কারণে চাইলে গুলি ছুড়তে পারতেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। অনেক প্রাণহানির অভিযোগও ওঠে। কিন্তু নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে ভেবেও সে পথে হাঁটেননি সেই সদস্য। ঘটনার সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সহকর্মীদের তাৎক্ষণিক বার্তা পাঠিয়ে নিজেই সামাল দেন পরিস্থিতির। আর সে কারণেই বাহবা পাচ্ছেন সাধারণ মানুষসহ কর্তাব্যক্তিদের।
গত ২৩ ডিসেম্বর, রোববার। নিউইয়র্ক শহরে তখন রাত। সাইদ আলী একা দায়িত্ব পালন করছিলেন ম্যানহাটনের ইস্ট ব্রডওয়ের সাবওয়ে (পাতাল রেল) স্টেশনে একসময় জানলেন, একজন নারীকে উত্ত্যক্ত করছেন পাঁচজন মদ্যপ। ছুটে এলেন সাইদ আলী। মাতালদের কাছে যেতেই তেড়ে এলেন তাঁরা। কারাতে ভঙ্গিতে আক্রমণের চেষ্টা করলেন। মাতালদের ওপর হাতের লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন আলী৷ পেছাতে পেছাতে বলতে থাকেন, ‘আমি তোমাদের আঘাত করতে চাই না, থামো!’ কিন্তু তাঁরা থামলেন না। সাইদ আলী সর্বোচ্চ পেশাদারির মাধ্যমে সামাল দিলেন মাতালদের।
সেদিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতেই মুখোমুখি হয়েছিলেন সংবাদমাধ্যমের। প্রথা মেনে সহকর্মীদের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন সাইদ আলী। সেখানে সেদিনের ঘটনা খোলাসা করে বললেন। বললেন কেন গুলি না চালিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে, ‘জীবন অনেক মূল্যবান। তাই কাউকে সর্বোচ্চ আঘাত করার আগে ক্ষণিকের জন্য হলেও দ্বিতীয়বার চিন্তা করা উচিত। আমি সেনাবাহিনী আর পুলিশের প্রশিক্ষণ থেকেই এ শিক্ষা পেয়েছি।’ প্রাপ্ত শিক্ষার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন সাইদ আলী। তাই তো সেদিনের ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ করে তাঁর বীরত্বের কাহিনি।
প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত কোনো এক যাত্রী দৃশ্যটি ভিডিও করেছিলেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন সেই ৪৩ সেকেন্ডের ভিডিও। মুহূর্তেই তা ভাইরাল হয়ে যায়। সবাই সাইদ আলীর নায়কোচিত ভূমিকার প্রশংসা করে শেয়ার করতে থাকেন। গত ২৪ ডিসেম্বর মাডি নামে এক ব্যক্তির টুইটার প্রোফাইল থেকে শেয়ার করা ভিডিওটিই ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেখেছেন প্রায় ৫১ লাখ মানুষ। বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ দেখলেও তা জানতেনই না সাইদ আলী। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন, ‘আমি জানতাম না মুহূর্তটি কেউ ভিডিও করেছে। সে সময় তো দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলাম। পরদিন সকালে বিভিন্নজনের ফোনে জানতে পারি৷’ জেনে বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি। হওয়ারই কথা, ততক্ষণে তিনি যে রীতিমতো নায়ক বনে গেছেন।
সাইদ আলীকে নিয়ে এতটাই আলোড়ন হয় যে ২৬ ডিসেম্বর তাঁকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত পত্রিকা দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও দিয়ে খবর প্রচার করে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল।
সাহসিকতার প্রশংসা সাধারণ মানুষ তো করেছেই। সেই সঙ্গে নিউইয়র্ক শহরের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাও সাইদ আলীকে ভাসিয়েছেন প্রশংসা বাক্যে। যেমন নিজের টুইটার প্রোফাইল থেকে টুইট করেছেন নিউইয়র্ক সিটির মেয়র বিল ডি ব্লাজিও।
নগরীর ব্রুকলিনের কাউন্সিলম্যান চেইম এম ডাচ তো নিজ হাতে সাইদ আলীর হাতে তুলে দিয়েছেন সাহসিকতার বিশেষ সনদ। ‘অফিসার আলী মহৎ কাজ করেছেন’ উল্লেখ করে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের (এনওয়াইপিডি) ট্রানজিট ব্যুরোর সহকারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ভিনসেন্ট কোগান বিবৃতি দিয়েছেন। নিউইয়র্কে পুলিশের প্যাট্রলম্যান বেনোভেল্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্যাট লিঞ্চ বলেছেন, ‘অফিসার সাইদ আলী তাঁর চরম পেশাদারি দেখিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। ঘটনা ভিন্ন খাতে যেতে পারত। রক্ত ঝরতে পারত। জীবনহানিও ঘটতে পারত।’
এ ছাড়া নিউইয়র্ক পুলিশে কর্মরত বাংলাদেশি পুলিশ অফিসারদের সংগঠন—বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) সাইদ আলীর এই সাহসিকতার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। সংগঠনের মিডিয়া লিয়াজোঁ কর্মকর্তা জামিল সারোয়ার বললেন, ‘সাইদ আলীর জন্য আমরা সত্যিই গর্বিত। বাংলাদেশিরা নিউইয়র্ক পুলিশে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।’
৩৬ বছর বয়সী সাইদ আলীর জন্ম বাংলাদেশের মৌলভীবাজারে । তিন বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন আলী। বড় হয়েছেন ব্রুকলিনে। পড়াশোনা শেষে কর্মজীবন শুরু করেন মার্কিন সেনাবাহিনীতে। সেখান থেকে ছয় বছর আগে যোগ দিয়েছেন নিউইয়র্কের পুলিশ বাহিনীতে। পুলিশ সদস্য হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন সাইদ আলী।
২০১৭ সালের ঘটনা। মুসলিম দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে সময় তুরস্কের ইস্তাম্বুল গিয়েছিলেন সাইদ আলী। ইস্তাম্বুল থেকে উড়োজাহাজে নামেন যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডি (জেএফকে) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখানেই তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়। সাবেক মার্কিন সেনাসদস্য পরিচয় দিলেও যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস অ্যান্ড ইমিগ্রেশন বিভাগের দীর্ঘ তল্লাশির মুখে পড়েন তিনি। সে অভিজ্ঞতা আলীর কাছে ছিল অপমানের। ২০১৭ সালের ১৫ মে নিউইয়র্ক টাইমস আলীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল। সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি আমার ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।’ ক্ষুব্ধ সাইদ আলী প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘যারা বিমানবন্দর দিয়ে আসবে, তাদের মধ্যে কারও নামে আলী থাকলেই কি সে জঙ্গি সন্দেহের তালিকায় থাকবে?’
সময় কত দ্রুত বদলে যায়। মাত্র দেড় বছরের মাথায় সেই সাইদ আলী বীরত্বের সম্মান পেলেন। তাঁর বীরত্ব আর পেশাদারির সংবাদ প্রচার হতে থাকল সঙ্গে। যোগ্য আমেরিকানের কাজ করেছেন বলে বাহবা পেলেন অনেকের।
তবে এত কিছুর সঙ্গে ঠিকই উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম। হবেই তো, বাংলাদেশেই যে সাহসী সাইদ আলীর শিকড়।