আপডেট

x


হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরামর্শ

বৃহস্পতিবার, ০৩ আগস্ট ২০১৭ | ১:০৯ অপরাহ্ণ | 1275 বার

হজযাত্রীদের স্বাস্থ্য পরামর্শ

হজের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বাড়তি চাপে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। ভৌগোলিক, জলবায়ু ও আবহাওয়াগত পরিবর্তনে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হজযাত্রীদের বেশকিছু স্বাস্থ্যগত অসুবিধা দেখা যায়। ভ্রমণকালে অনেকের শারীরিক সমস্যা ও মানসিক অস্বস্তি বোধ হয়।

ভ্রমণকালীন সমস্যা : সাধারণত হজযাত্রীরা বিমান ভ্রমণে অনভ্যস্ততার কারণে বমি, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের সমস্যায় ভুগে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে বিমান সুউচ্চ পর্বত ও মেঘমালা এড়ানোর জন্য ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উচ্চতা অতিক্রম করে (প্রায় ৬০০০-৮০০০ ফুট ওপর দিয়ে) চলতে হয়। তখন ঊর্ধ্বাকাশে বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের চাপ কম থাকায় রক্তের অক্সিজেনের মাত্রা নিচে নেমে আসে। ফলে অ্যাজমা রোগীদের শ্বাসকষ্ট এবং তীব্র মাথাব্যথা অনুভব হয়।



তাপমাত্রার পার্থক্য : জেদ্দা বিমানবন্দরে নামার পরপরই আবহাওয়াগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আমাদের দেশের তাপমাত্রার সঙ্গে মরু অঞ্চলে তাপমাত্রার ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় জলীয় বাষ্পের আর্দ্রতায় একটা ভারসাম্য রয়েছে। অন্যদিকে সৌদি আরবের তাপমাত্রা সাধারণত ৪০-৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে, সেইসঙ্গে বাতাসে জলীয় বাষ্পের আর্দ্রতাও কম থাকে। অতিরিক্ত গরমে হিটস্ট্রোক হতে পারে। সঙ্গে ডায়রিয়া, বমি ও মাত্রাতিরিক্ত ঘামে ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়। ফলে শরীর থেকে লবণ বের হয়ে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য ঠিক থাকে না; ফলে শারীরিক দুর্বলতা, মাথাব্যথা, স্ট্রেস ও ঝিমানি এবং বমি বমি ভাব হতে পারে। তাছাড়া পানিশূন্যতায় গাঢ় হলুদ বর্ণের মূত্র নিঃসরণ হতে পারে।

ত্বকের সমস্যা : সূর্যের আলো সরাসরি গায়ে লাগায় এর ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে মুখমণ্ডল, বাহু ও বুকের চামড়ায় সানবার্ন হতে পারে।

সংক্রামক ব্যাধি : পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত লোকজন একত্রে ঘন পরিবেশে বসবাস, বাতাসে হাঁচি-কাশি এবং হাতের স্পর্শে বিভিন্ন ফ্লু’র সংক্রমণ ঘটতে পারে। কখনও কখনও তা মহামারী আকারে ছড়াতে পারে। সাধারণত ম্যানিনগোকক্কাল ইনফেকশন, হেপাটাইটিস-এ এবং হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস, মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফয়েড ফিভার, ইয়েলো ফিভার, ম্যালেরিয়া জ্বর এবং ১৫ বছরের কমবয়সীদের ক্ষেত্রে পলিও ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।

ম্যানিনগোকক্কাল ম্যানিনজাইটিস : হজযাত্রীদের জন্য রোগটি আতংকের কারণ। একটি সমীক্ষায় জানা যায়, ৪০% ক্ষেত্রে অতি জনবহুল অবস্থায় ম্যনিনগোকক্কাল জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তাই সৌদি সরকার এ রোগের জন্য বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিন গ্রহণের নিয়ম চালু করেছে। ভিসা অনুমোদনের জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষ ইন্টারন্যাশনাল ভ্যাকসিনেশন বোর্ডের দেয়া ছাড়পত্র মোতাবেক ভিসা মঞ্জুর করে থাকে।

টনসিলাইটিস ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ : অতিরিক্ত গরমে ডিপ ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি পানে গলা বসে যাওয়া, গলা ব্যথা ও টনসিলাইটিস এমনকি ঊর্ধ্ব শ্বাসনালিতে সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। এছাড়া শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ যেমন- একুইট ও ক্রোনিক ডিজঅর্ডার দেখা দিতে পারে। স্থান ও পরিবেশগত পার্থক্যের জন্য ঠাণ্ডা জ্বর ও ইনফ্লুয়েঞ্জাও আক্রমণ করতে পারে।

আন্ত্রিক রোগ : খাদ্যাভাসগত পরিবর্তনের জন্য পাকস্থলি ও অন্ত্রের নানাবিধ সমস্যা হয়ে থাকে। সাধারণত হাইপার অ্যাসিডিটি, ক্ষুধামন্দা, কোষ্ঠবদ্ধতা, আমাশয়, পাতলা পায়খানা এবং ট্যাপের পানি এবং অসিদ্ধ খাবার গ্রহণের ফলে টাইফয়েড ও প্যারা-টাইফয়েড ফিভার, সংক্রমণ হতে পারে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বয়স্ক হজযাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রায় ৩০ শতাংশই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। প্রয়োজনীয় পরিমাণে ফলমূল এবং শাকসবজি না খেয়ে কেবল প্যাকেটজাত খাবার গ্রহণ করায় কোষ্ঠকাঠিন্য একটি অতি সাধারণ সমস্যা হিসেবে দেখা যায়।

ট্রুমা বা আঘাত : হজের অষ্টম ও নবম দিবসে হজের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয়। অষ্টম দিবসে বিশেষ করে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রাকালে অতিরিক্ত গরম, কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ ও ভিড়ের মধ্যে যাত্রাকালে আঘাত, মাথাব্যথা, বমি ভাব বিশেষ করে বয়স্ক ও বাতের রোগীদের অতিরিক্ত হাঁটাচলার কারণে বাতব্যথা বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া হেরেম শরিফ তওয়াফ করার সময় হুড়োহুড়িতে আঘাত লাগতে পারে।

বয়স্ক ও জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে : বয়স্ক ব্যক্তি, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগীরা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতিতে নানা রকম শারীরিক জটিলতার শিকার হন। অনেকের ক্ষেত্রে হাইপো ও হাইপার গ্লাইসোমিয়া দেখা দেয় এবং কারো কারো ক্ষেত্রে জটিলতার কারণে রোগী কোমায় চলে যায়।

করণীয় : প্রত্যেক হজযাত্রীর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তুতি নেয়া জরুরি। প্রত্যেক হজযাত্রীর বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণ ও নিজ উদ্যোগে ফার্স্ট এইড প্যাকেজ সংগ্রহ এবং একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শক্রমে সাধারণ রোগের ওষুধগুলো ভ্রমণকালে সঙ্গে রাখতে হবে।

ভ্যাকসিনেশন : ম্যানিনগোকক্কাল ইনফেকশন প্রতিরোধের জন্য এসিওয়াইডব্লিও-১৩৫ এবং ফ্লু ভ্যাকসিন নিতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনে টিটেনাস, ডিপথেরিয়া, পার্টোসিস ও পলিও ভাইরাসের জন্য ভ্যাকসিন নিতে হবে।

ফার্স্ট এইড চিকিৎসা : ড্রেসিং করার জন্য সব উপাদান, বিষাক্ত পোকামাকড়ের জন্য অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম, পানি পরিশোধনের জন্য জীবাণুমুক্ত ট্যাবলেট সঙ্গে রাখা।

পানি ও লবণের সাম্যতা : অতিরিক্ত ঘামে ইলেকট্রলাইটের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সল্ট ট্যাবলেট নিতে হবে। এটি পাওয়া না গেলে বিকল্প হিসেবে সারাদিনের জন্য দুই টেবিল চা চামচ সাধারণ লবণ খাবার পানির সঙ্গে ব্যবহার করা। আরবে প্রাপ্ত লাবান (মাঠা) এ ক্ষেত্রে উপকারী।

জ্বর ও মাথাব্যথায় : জ্বর ও সাধারণ ব্যথাজনিত কারণে প্যারাসিটামল ও ক্যাফেইনমুক্ত অ্যান্টিপাইরেটিক ও এনালজেসিক ওষুধ সঙ্গে রাখা দরকার।

টনসিলের ব্যথায় : ঠাণ্ডাজনিত গলাব্যথা ও টনসিলের ব্যথার জন্য জিঞ্জার বা শুকনো আদার চা অথবা গরম পানির গড়গড়ায় উপকারী ফল পাওয়া যায়।

ট্রুমা : আঘাতজনিত ব্যথায় ডাইক্লোফেন বা এসিক্লোফেনাকযুক্ত ওষুধ এবং আক্রান্ত স্থানে লাগানোর জন্য ব্যথানাশক জেল সঙ্গে রাখা।

পেটের পীড়ায় : পাতলা পায়খানা ও আমাশয় হলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওরাল রিহাইড্রেশন স্যালাইন বা খাওয়ার স্যালাইন এবং সঙ্গে মেট্রোনিডাজলযুক্ত ওষুধ আর পেটের অতিরিক্ত অম্লতার জন্য ডমপেরিডন সংগ্রহে রাখা।

শ্বাসকষ্টে : হাঁপানি বা অ্যাজমা রোগীদের জন্য সালবিউটামল সালফেটযুক্ত ব্রংকোডায়ালেটর ট্যাবলেট উপকারী।

অতিরিক্ত অম্লতায় : হাইপার অ্যাসিডিটি বা অম্লাধিক্যের জন্য অ্যালুমিনিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম সালফেটযুক্ত চুয়েবল এন্টাসিড ট্যাবলেট সঙ্গে রাখা ভালো। আর অবিরত অ্যাসিডিটির সমস্যায় চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে রেনিটিডিন, ওমিপ্রাজল অথবা প্যান্টোপ্রাজলযুক্ত ওষুধ সঙ্গে রাখা যেতে পারে।

অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় : ধুলোবালি ডাস্ট ও মাইট দ্বারা আক্রান্ত হলে সেটিরিজিনযুক্ত অ্যান্টিহিস্টামিনজাতীয় ট্যাবলেট উপকারী।

ভ্রমণকালীন অস্বস্তি : মাথা ধরা ও বমি বমি ভাব দূর করতে অ্যান্টিবমিটিং ড্রাগ সঙ্গে রাখা ভালো।

জটিল রোগ : হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ ডায়াবেটিস ও হাঁপানি রোগীদের জন্য আগে থেকে নিজ চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করে হজের মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ এবং হজযাত্রার আগপর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে কয়েকবার শারীরিক চেকআপ করাতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে ব্যবহার্য সব ওষুধ সাবলিংগুয়াল ট্যাবলেট ইনসুলিন ও ইনহেলার যথাযথ লেবেলিং করে ভ্রমণকালে কাছাকাছি রাখতে হবে।

পরামর্শ ও সতর্কতা : আমাদের দেশ থেকে যেসব হজযাত্রী মক্কা শরিফে গমন করেন তাদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ। তাই অতিরিক্ত কায়িক শ্রমে দৈহিক সুস্থতার জন্য প্রতিদিন একটি করে মাল্টিভিটামিন নেয়া যেতে পারে। আরাফাতের ময়দান ও মিনায় অবস্থান, মুজদালেফায় মাগরিব ও এশার নামাজ একত্রে আদায়, কঙ্কর নিক্ষেপ এবং হেরেম শরিফ তওয়াফ হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে অন্যতম। অষ্টম থেকে দশম দিবসের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন এ কাজগুলো সমাধান করতে হয়। তাই মাত্রাতিরিক্ত ভিড় ও চাপের মুখে আঘাতসহ অন্য অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে কিছু সতর্কতামূলক বিষয়গুলো সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

ফুসফুসে রোগ বিশেষ করে যারা নিউমোথোরাক্স রোগে আক্রান্ত তাদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বিমান পরিভ্রমণ অনুচিত। ঊর্ধ্বাকাশে বিমান পরিভ্রমণকালে অক্সিজেনের স্বল্পতায় হাঁপানি রোগীদের ক্ষেত্রে তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়, তাই ইনহেলার অবশ্যই কাছে রাখতে হবে। ডিহাইড্রেশন ও কোষ্ঠবদ্ধতা এড়ানোর জন্য প্রতি দু-তিন ঘণ্টা পর পর প্রচুর পানি পান করতে হবে। বদহজমজনিত সমস্যায় কারমিনেটিভজাতীয় ওষুধ সেবন করা। সরাসরি সূর্যের আলো গায়ে না লাগানো, একটানা দীর্ঘক্ষণ না হেঁটে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হাঁটা, অত্যাধিক জনবহুল পরিবেশ এড়িয়ে চলা, প্রয়োজন অনুপাতে বিশ্রাম ও ঘুমানো। শরীর ঠাণ্ডার রাখার জন্য শীতল খাদ্যদ্রব্য ও প্রচুর পানি পান করা। সূর্যের ভয়াবহ তাপ ও ক্ষতিকর আলোক রশ্মি থেকে ত্বক রক্ষা করার জন্য মুখের ওপর সাদা কাপড় সানস্ক্রিন লোশন ও ছাতা ব্যবহার করা। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। চশমা বা কন্ট্রাক্ট লেন্স ব্যবহার করলে সতর্কতামূলক অতিরিক্ত আরও একটি সঙ্গে নেয়া ভালো। পুরুষের ক্ষেত্রে মাথা মুণ্ডনকাণীন সময়ে একই ব্লেড ব্যবহার করায় হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার আশংকা রয়েছে, তাই অন্যের ব্যবহৃত রেজার বা ক্ষুর ব্লেড ব্যবহার না করা। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি নজর দিতে হবে। বিশেষ করে হ্যান্ড-ল্যাগেজ, পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং সরঞ্জামাদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা। ভ্যালিড ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স কার্ড থাকলে তা সঙ্গে রাখতে হবে। একাকী রাস্তায় না বেড়িয়ে গ্রুপভিত্তিক চলাচল করা, বিশেষ করে ট্রাফিক আইন মেনে চলা। সর্বোপরি সবচেয়ে ভালো হয় যৌবনকাল অর্থাৎ দৈহিক সামর্থ্য থাকাকালে হজব্রত পালন করা।

লেখক : রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল, ঢাকা

মন্তব্য করতে পারেন...

comments


deshdiganto.com © 2019 কপিরাইট এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত

design and development by : http://webnewsdesign.com