ঢাকা , শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আপডেট :
বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনে হত্যার প্রতিবাদে পর্তুগালে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশী প্রবাসীরা প্রিয়জনদের মানসিক রোগ যদি আপনজন বুঝতে না পারেন আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা ও অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা করেছে পর্তুগাল আওয়ামীলীগ যেকোনো প্রচেষ্টা এককভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়: দুদক সচিব শ্রীমঙ্গলে দুটি চোরাই মোটরসাইকেল সহ মিল্টন কুমার আটক পর্তুগালের অভিবাসন আইনে ব্যাপক পরিবর্তন পর্তুগাল বিএনপি আহবায়ক কমিটির জুমে জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয় এমপি আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার ঘটনায় আটক তিনজন , এতে বাংলাদেশী মানুষ জড়িত:স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকাস্থ ইরান দুতাবাসে রাইসির শোক বইয়ে মির্জা ফখরুলের স্বাক্ষর

তোমার বাবা কী করে ?

নিউজ ডেস্ক
  • আপডেটের সময় : ০৮:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৯
  • / ৭০৫ টাইম ভিউ

এই প্রশ্নটা খুবই আপত্তিকর। একটা ছোট শিশু নিজেকে চিনতে শেখার আগেই তাকে শিখতে হচ্ছে তার বাবার পেশা। অবশ্য, নামেই পেশা, মূলত সেটা সামাজিক পরিচিতি। স্কুলে গেলে ক্লাস ওয়ান-টু এর বাচ্চাগুলোও জানে অমুকের বাবা ডাক্তার, তমুকের বাবা ব্যারিস্টার। এবং স্বভাবতই যার বাবার পেশাগত তেমন কোন সামাজিক পরিচিতি নেই, সে ব্রাত্য হয়ে থাকে সেই শিশুদের শ্রেণীকক্ষেই।

আমার বিচিত্র ধরণের বন্ধুদের কথা অনেকে জানেন। এমনই একজন বিচিত্র বন্ধু ছিল হাসিব। কিছুটা তোতলা ছিল। তার বাবা পেশায় একজন ট্রাক চালক ছিলেন। মা ছিলেন গার্মেন্টস কর্মী। একটামাত্র ঘর ভাড়া নিয়ে হাসিবরা থাকত আমাদের এলাকায়। বিকেলে গলির ভেতর ফুটবল খেলতে সবাই যেতাম, সবার বাবাই কিছু না কিছু, শুধু হাসিবের বাবা একজন ট্রাক চালক। ট্রাক চালক হওয়া কোন অপরাধ না হলেও সেই বয়সেই আমরা বুঝতে পারতাম সচিব-ব্যারিস্টারের মত সামাজিক সম্মানও এই পেশায় নেই। আমরা মাঝে মাঝেই এর ওর বাসায় যেতাম বিকালে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খেলতে বের হবার জন্যে ডাকতে। কোন বাসায় যদি কেউ হাসিবকে জিজ্ঞেস করে বসত- “এই ছেলে তোমার বাবা কী করে?”, হাসিব খুব বিব্রত বোধ করত। মাথা নিচু করার জন্যেই হোক আর বিব্রত বোধ করার জন্যেই হোক, হাসিবের তোতলামি কয়েকগুণ বেড়ে যেত তখন। সে কোনমতে বলত- টা টা টা টারাক চালায়। তখন প্রশ্নকর্তা বা প্রশ্নকর্ত্রী এমনভাবে “ও” বলতেন হাসিবের মনটাই খারাপ হয়ে যেত। সবাই যখন বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে, সে মুখ শুকনা করে গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে ঘাস চিবাতো।

কলেজে প্রথম দিনের ফিজিক্স ক্লাস। প্রয়াত প্রফেসর চন্দন কুমার বোস (আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধার একজন শিক্ষক) সবার নাম ধাম জানতে চাইছেন। রাবেয়া নামে একটা মেয়ে ছিল সে মাথা নিচু করে বলল, “আমার বাবা বাবুর্চির কাজ করে”। পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে উঠল। রাবেয়াকে আর কোনদিন ওর বাবা কী করে সেটা কারও কাছে বলতে শুনিনি।

সবার বাবাই সবার কাছে ঈশ্বরের মতো। নিজেই সর্বশ্রেষ্ঠ এই মতবাদ প্রমাণের আজকের পৃথিবীতে সকল পেশার সমান মূল্যায়ন হয়তো কখনও হবে না, কিন্তু মেথরের সন্তানের কাছে তার বাবা আর প্রেসিডেন্টের সন্তানের কাছে তার বাবা সবসময় একই রকম থাকবে। কেন শিশুদের মাথায় আমরা ঢুকিয়ে দিচ্ছি এই ভ্রষ্ট ধারণাটা- তোমার বাবা কিছুই না/তোমার বাবা একদম হাতি-ঘোড়া? কী যায় আসে যদি আমার বাবা কিছুই না হন? কী যায় আসে যদি আমার বাবা দেশের সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তি হন? মানুষ হিসেবে আমার পরিচয় কি আমার বাবা কে দিয়ে হবে?

শৈশবে একটা সময় আমাদের এলাকায় অনেক চুরি হতো। পাশের বাসার নাজির মামা সারা রাত পোষা কুকুর নিয়ে জেগে বসে থাকতেন আর প্রায়ই চোর ধরে ফেলতেন। প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে দেখতাম একটা চোর ধরা পড়েছে রাতে, আর তাকে মহাসমারোহে এলাকার সবাই মিলে বেঁধে পিটাচ্ছে। একদিন দেখলাম এরকম একজন মানুষকে চ‌োর বলে পেটানো হচ্ছে, একটু দূরে মানুষটার স্ত্রী আমার বয়েসী একটা ছেলের হাত ধরে কাঁদছে। ছেলেটার চোখে পানি নেই, তবে বিস্ময় আছে। সে একটু পর পর বলছে, “আমার আব্বারে মাইরেন না, আমার আব্বা তো চোর না।” একজন ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “তাইলে তর বাপে কী?” ছেলেটা তখন থতমত খেয়ে বলল, “আমার আব্বা”।

ছেলেটা ঠিকই বলেছিল। তার বাবার পরিচয় তার কাছে শুধুই বাবা, বাবার পেশা না। বাবা পেশায় চোর হলেও তার কাছে তো ঈশ্বরের মতোই। যেই ছেলেটা বাবা সচিব বলে নিজেকে উপসচিব মনে করে, বাবা ডাক্তার বলে নিজেকে অর্ধেক ডাক্তার মনে করে ওরা কখনও স্বীকার করে না যে বাবা ঘুষ খায় বা অন্যায়ভাবে টাকার পাহাড় গড়ে। তবে সেই ছেলেটা বাবা চোর দেখেই কিন্তু নিজেকে অর্ধেক চোর মনে করেনি, খুব সহজ ভাবে সত্যি কথাটাই বলেছিল- আমার আব্বা।

যেই স্কুলে শিখানো হচ্ছে ‘জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভাল’, সেই স্কুলেই কেবলমাত্র বাবার পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে শিশুকে সুবিধা/স্নেহ দেয়া হচ্ছে। এর চেয়ে বড় হিপোক্রেসি আর কী হতে পারে?

পোস্ট শেয়ার করুন

তোমার বাবা কী করে ?

আপডেটের সময় : ০৮:১৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০১৯

এই প্রশ্নটা খুবই আপত্তিকর। একটা ছোট শিশু নিজেকে চিনতে শেখার আগেই তাকে শিখতে হচ্ছে তার বাবার পেশা। অবশ্য, নামেই পেশা, মূলত সেটা সামাজিক পরিচিতি। স্কুলে গেলে ক্লাস ওয়ান-টু এর বাচ্চাগুলোও জানে অমুকের বাবা ডাক্তার, তমুকের বাবা ব্যারিস্টার। এবং স্বভাবতই যার বাবার পেশাগত তেমন কোন সামাজিক পরিচিতি নেই, সে ব্রাত্য হয়ে থাকে সেই শিশুদের শ্রেণীকক্ষেই।

আমার বিচিত্র ধরণের বন্ধুদের কথা অনেকে জানেন। এমনই একজন বিচিত্র বন্ধু ছিল হাসিব। কিছুটা তোতলা ছিল। তার বাবা পেশায় একজন ট্রাক চালক ছিলেন। মা ছিলেন গার্মেন্টস কর্মী। একটামাত্র ঘর ভাড়া নিয়ে হাসিবরা থাকত আমাদের এলাকায়। বিকেলে গলির ভেতর ফুটবল খেলতে সবাই যেতাম, সবার বাবাই কিছু না কিছু, শুধু হাসিবের বাবা একজন ট্রাক চালক। ট্রাক চালক হওয়া কোন অপরাধ না হলেও সেই বয়সেই আমরা বুঝতে পারতাম সচিব-ব্যারিস্টারের মত সামাজিক সম্মানও এই পেশায় নেই। আমরা মাঝে মাঝেই এর ওর বাসায় যেতাম বিকালে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খেলতে বের হবার জন্যে ডাকতে। কোন বাসায় যদি কেউ হাসিবকে জিজ্ঞেস করে বসত- “এই ছেলে তোমার বাবা কী করে?”, হাসিব খুব বিব্রত বোধ করত। মাথা নিচু করার জন্যেই হোক আর বিব্রত বোধ করার জন্যেই হোক, হাসিবের তোতলামি কয়েকগুণ বেড়ে যেত তখন। সে কোনমতে বলত- টা টা টা টারাক চালায়। তখন প্রশ্নকর্তা বা প্রশ্নকর্ত্রী এমনভাবে “ও” বলতেন হাসিবের মনটাই খারাপ হয়ে যেত। সবাই যখন বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে, সে মুখ শুকনা করে গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে ঘাস চিবাতো।

কলেজে প্রথম দিনের ফিজিক্স ক্লাস। প্রয়াত প্রফেসর চন্দন কুমার বোস (আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধার একজন শিক্ষক) সবার নাম ধাম জানতে চাইছেন। রাবেয়া নামে একটা মেয়ে ছিল সে মাথা নিচু করে বলল, “আমার বাবা বাবুর্চির কাজ করে”। পুরো ক্লাস হো হো করে হেসে উঠল। রাবেয়াকে আর কোনদিন ওর বাবা কী করে সেটা কারও কাছে বলতে শুনিনি।

সবার বাবাই সবার কাছে ঈশ্বরের মতো। নিজেই সর্বশ্রেষ্ঠ এই মতবাদ প্রমাণের আজকের পৃথিবীতে সকল পেশার সমান মূল্যায়ন হয়তো কখনও হবে না, কিন্তু মেথরের সন্তানের কাছে তার বাবা আর প্রেসিডেন্টের সন্তানের কাছে তার বাবা সবসময় একই রকম থাকবে। কেন শিশুদের মাথায় আমরা ঢুকিয়ে দিচ্ছি এই ভ্রষ্ট ধারণাটা- তোমার বাবা কিছুই না/তোমার বাবা একদম হাতি-ঘোড়া? কী যায় আসে যদি আমার বাবা কিছুই না হন? কী যায় আসে যদি আমার বাবা দেশের সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তি হন? মানুষ হিসেবে আমার পরিচয় কি আমার বাবা কে দিয়ে হবে?

শৈশবে একটা সময় আমাদের এলাকায় অনেক চুরি হতো। পাশের বাসার নাজির মামা সারা রাত পোষা কুকুর নিয়ে জেগে বসে থাকতেন আর প্রায়ই চোর ধরে ফেলতেন। প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে দেখতাম একটা চোর ধরা পড়েছে রাতে, আর তাকে মহাসমারোহে এলাকার সবাই মিলে বেঁধে পিটাচ্ছে। একদিন দেখলাম এরকম একজন মানুষকে চ‌োর বলে পেটানো হচ্ছে, একটু দূরে মানুষটার স্ত্রী আমার বয়েসী একটা ছেলের হাত ধরে কাঁদছে। ছেলেটার চোখে পানি নেই, তবে বিস্ময় আছে। সে একটু পর পর বলছে, “আমার আব্বারে মাইরেন না, আমার আব্বা তো চোর না।” একজন ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল, “তাইলে তর বাপে কী?” ছেলেটা তখন থতমত খেয়ে বলল, “আমার আব্বা”।

ছেলেটা ঠিকই বলেছিল। তার বাবার পরিচয় তার কাছে শুধুই বাবা, বাবার পেশা না। বাবা পেশায় চোর হলেও তার কাছে তো ঈশ্বরের মতোই। যেই ছেলেটা বাবা সচিব বলে নিজেকে উপসচিব মনে করে, বাবা ডাক্তার বলে নিজেকে অর্ধেক ডাক্তার মনে করে ওরা কখনও স্বীকার করে না যে বাবা ঘুষ খায় বা অন্যায়ভাবে টাকার পাহাড় গড়ে। তবে সেই ছেলেটা বাবা চোর দেখেই কিন্তু নিজেকে অর্ধেক চোর মনে করেনি, খুব সহজ ভাবে সত্যি কথাটাই বলেছিল- আমার আব্বা।

যেই স্কুলে শিখানো হচ্ছে ‘জন্ম হোক যথাতথা কর্ম হোক ভাল’, সেই স্কুলেই কেবলমাত্র বাবার পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে শিশুকে সুবিধা/স্নেহ দেয়া হচ্ছে। এর চেয়ে বড় হিপোক্রেসি আর কী হতে পারে?