বটবৃক্ষের ছায়ায় – – শাহারুল কিবরিয়া
- আপডেটের সময় : ০৩:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ মে ২০২০
- / ২৫১৬ টাইম ভিউ
বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
রবীন্দ্রনাথের এই অমর কবিতার মতই দাড়াচ্ছে ব্যাপারটা। লেখালেখির অভ্যাসটা আবারও ঝালিয়ে নিতে গিয়ে কত কিছু নিয়েই না ভাবছি লিখব বলে! অথচ যেখানে এই লেখার শুরু, যে কারণে আমার অল্পবিস্তর লেখালেখির অভ্যাস, সেই বটবৃক্ষ আমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। একটি শিশির বিন্দু যেমন আমাদের চোখে পড়েনা, দেখি গিয়ে হিমালয়ের জমাট বরফ, তেমনি আমিও এক বটবৃক্ষকে না দেখে নার্সারিতে নার্সারিতে মনকে নিয়ে সদাই করছি লেখার সাবজেক্ট কিনব বলে!!
এই বটবৃক্ষের জন্ম ইতিহাস সৃষ্টি করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ রাজের থেকে ভারত পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ঠিক আগে দিয়ে জন্ম নেন পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ফরিদা বেগম। আমার মা। এই ব্যক্তিকে নিয়ে কত কিছুই তো লিখা যায়!! আমি খুঁজে মরি লেখার সাবজেক্ট!!
আম্মার জন্ম তার বাড়িতে, বড়লেখার পাকশাইল গ্রামে। আমার নানা ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান কাস্টমস এর কর্মকর্তা। বদলির চাকরি। সেই সুবাদে আম্মার ছেলেবেলা কেটেছে দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে। চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, বগুড়া, হবিগঞ্জ আর সিলেটের নানা জায়গায়। আম্মা তাঁর বাবা মায়ের প্রথম সন্তান হওয়ার কারণে বাবা মায়ের সাথে যেখানেই গেছেন, অবারিত সুযোগ ছিলো সব ঘুরে দেখার, সব কিছুর সাথে পরিচয় হওয়ার। আমার বড় মামা একেএম ফারুক ছিলেন তার ছোটবেলার সব দস্যিপনার সহচর!! এখানে অনেকেই হয়ত ভ্রু কুঁচকে উঠবেন!! ফরিদা ম্যাডামের আবার দস্যিপনা!! বলে কি?
যারা আম্মাকে শিক্ষক অথবা সহকর্মী হিসেবে পেয়েছেন তাঁরা তাঁকে চেনেন “মেঘলা ম্যাডাম” নয়ত “বাংলার বাঘ” (স্থানীয়ভাবে দেয়া নাম) হিসেবে। দস্যিপনা সেখানে আসে কোত্থেকে? আম্মার ছেলেবেলা যারা দেখেছেন তারা জানেন আম্মা কত দূরন্ত ছিলেন তার বাল্যকালে। ছেলেমেয়েদের সম্মিলিত খেলায় দাড়িয়াবান্ধা বৌচি ডাংগুলি কি খেলেননি আম্মা!
পড়াশোনা করেছেন সারা দেশজুড়ে। মৌলভীবাজার স্কুল থেকে মেট্রিক আর সিলেট মহিলা কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেছেন। বড়লেখার মেয়েদের মধ্যে ছিলেন তৃতীয় মেট্রিকুলেশন পাশ। এমএ পাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, ১৯৬৯ সালে।
সালটা দেখেই বুঝা যায় কি উত্তপ্ত সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন আম্মা।
অনেকে ১৯৫২ সালে হয়ত ছাত্র ছিলেন, ১৯৬৯ এ হয়ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় হেঁটে গিয়েছেন, তারা আজ নিজেদের ভাষা সৈনিক আর গণআন্দোলনের সক্রিয় কর্মী বলে পরিচয় দেন।
১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে শহীদ আসাদের বোন নুরজাহান ছিলেন রোকেয়া হলের আবাসিক ছাত্রী। বোটানির ছাত্রী নুরজাহান আম্মার একই ব্যাচের ছাত্রী, আর রোকেয়া হলের রুমমেট। শহীদ আসাদের শার্ট নিয়ে সেই ঐতিহাসিক মিছিলে অন্যান্যদের সাথে শরিক হয়েছিলেন আম্মা । কুলাউড়া ডিগ্রি (তৎকালীন) কলেজের খুব ঘনিষ্ঠ ২-৪ জন অধ্যাপক ছাড়া মনে হয় না এই তথ্য কেউ জানেন।
১৯৬৯ সালের ২২ অথবা ২৩ ফেব্রুয়ারী, সহপাঠী ফরিদা আক্তার (মেরী) কে সাথে নিয়ে আম্মা গেলেন ঢাকা নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে। গিয়ে দেখেন সব বন্ধ।একজন দোকানীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারা অন্তরীণ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দিয়েছে সরকার।সবাই যাচ্ছে সেন্ট্রাল জেলে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসতে, তাই মার্কেট বন্ধ। আম্মা উনার বান্ধবীকে নিয়ে ফিরে আসলেন রোকেয়া হলে। হলের নিচতলায় একপাশে এক মুচি বসে।মুচির কাছে জুতা সেলাই করতে দিয়ে পাশেই বসে আছেন সাদা জমিনে সবুজ পাড়ের শাড়ি পরা এক ছাত্রী। আম্মা আর মেরি খালা সেই ছাত্রীর কাছে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর দিতেই মুচির কাছ থেকে জুতা একরকম ছিনিয়ে নিয়েই ভোঁ দৌড় লাগালেন শেখ মুজিব তনয়া বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা!!
এরকম স্মৃতি আম্মা নিজের মাঝে রেখেছেন। আমরা পরিবারের লোকজন ছাড়া আর দু’চারজন হয়ত জানেন এগুলো। অথচ এমন স্মারক থাকলে অনেকেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে হয়ত আখের গুছিয়ে নিতেন। আম্মার এমন অনেক ছাত্র আছেন প্রশাসনের সেই স্তরে যারা এই সুযোগ করে দিতেও পারেন৷ পারিবারিক ভাবেও সুযোগটা কম নয়। কিন্তু আম্মা কখনও এটা ভাবেন ও না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই যুগের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলেন শহীদ অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, অধ্যাপক এম.এ হাই, সদ্য পরলোকগত অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, ড. রফিকুল ইসলাম, ড. নীলিমা ইব্রাহীম, ড. আহমদ শরীফ প্রমুখ। এদের আলোয় আলোকিত হয়েছেন উনি। কিন্তু জীবনের অংকে খুব একটা লাভবান হতে পারেননি, হয়ত এটাও উনার শিক্ষার কারণেই।
আমার নানার শখ ছিলো বড় মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন। সেসময় সিলেট মেডিকেল স্কুল (তৎকালীন) বন্ধ হয়ে যায় বছর কয়েকের জন্য। তাই আম্মার আর ডাক্তারী পড়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ ডিগ্রী নিয়ে সিলেট মহিলা কেলেজে বাংলার অনারারী লেকচারার হিসেবে যোগ দিলেন। মহিলা কলেজের প্রিন্সিপাল তখন অধ্যাপক হুসনে আরা। আম্মার শিক্ষকও। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলো কিছুদিন পরই। আর তখনই নানা হার্ট এটাক করলেন। অধ্যাপক হুসনে আরার স্বামী শহীদ ডাঃ শামসুদ্দিনের সহায়তায় সেই সময়ের একটিমাত্র আইসিইউ বেডে জায়গা হলো নানার। যুদ্ধের ডামাডোল আরও বেড়ে গেলে অসুস্থ নানাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ডাঃ শামসুদ্দিন। তাঁর কিছুদিন পরই পাক বাহিনীর হাতে শহীদ হলেন ডাঃ শামসুদ্দিন। বাংলাদেশের ইতিহাসের এমন অনেক অধ্যায়ের সাথেই নীরবে নিভৃতে জড়িয়ে আছেন আম্মা৷। হয়ত পুরো পরিবারই।কিন্তু এসবকে কাজে লাগাতে অনীহা চরম।
অধ্যাপক হুসনে আরার সাথে মনোমালিন্য হওয়াতে মহিলা কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আম্মা কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগে যোগ দিলেন৷ অধ্যাপক হুসনে আরা আমার নানাকে দিয়ে অনেক চেষ্টা করেছেন আম্মাকে ফিরিয়ে আনার, আসেননি। বাকী জীবন আম্মা প্রায় পুরোটা কুলাউড়ায় কাটিয়ে এখন সিলেটবাসী।
কুলাউড়া কলেজে কেমন ছিলো আম্মার পরিচিতি?
কেউ বিশ্বাস করেন বা না করেন, আমি কিন্তু ক্লাস এইট পর্যন্ত কুলাউড়া কলেজে পড়েছি!! ছোটবেলায় আম্মার হাত ধরে কলেজে যেতাম।
কখনো ক্লাসরুমে আবার কখনো বাইরে অসংখ্য ছাত্র হয়ে যেতেন আমার শিক্ষক। পরে বর্তমানে এমসি কলেজের গণিতের অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন স্যার কলেজেই আমাকে অংক শেখাতেন। যাই হোক এই অগ্রীম কলেজ শিক্ষার কারণেই আম্মাকে আমি অন্যরূপেও দেখেছি। আম্মা ক্লাসে ঢুকে বলতেন “কেউ কথা বলবে না” আর অমনি কোলাহল সব আশ্চর্যজনকভাবে থেমে যেত!! আম্মা পড়াতেন: উঠিলা রাক্ষসপতি প্রাসাদ-শিখরে, কনক-উদয়াচলে দিনমণি যেন অংশুমালী। এই বলতো অংশুমালী মানে কি? হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে ক্লাসের সবচে’ ভালো ছাত্রটিকেও আমতা আমতা করতে হতো! আম্মার প্রশ্নে উত্তর ভুলে যেত ছাত্ররা। কেন আমি জানিনা। পরবর্তীতে আমি নিজেও যখন আম্মার ছাত্র হলাম আমার সহপাঠীদেরও এমন হতে দেখেছি। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করতো আম্মা বাসায় হাসেন কিনা!! আমি অবাক হয়ে বলতাম “হাসবে না কেনো? ” এত ভয়!! আসলে ভক্তি আর শ্রদ্ধা। আম্মা যেন পরীক্ষায় ডিউটি না করে তার জন্য মিছিল হয়েছে, আম্মার নকলবিরোধী কঠোরতার শিকার হয়ে কেউ কেউ ককটেল মারতে চেয়েছে, কেউ বাসায় এসে হুমকি দিতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা হয়েছে। অথচ বাসায় যখন মাহবুবা বেগম (মীরা) খালা আর সিঁথি সেন খালা আসতেন কি যে অবস্থা হতো। হৈচৈ আরম্ভ হয়ে যেত বাসায়। ছাত্ররা এঁদের এই অবস্থায় দেখলে ভিরমি খেত!! আমরা চার ভাই বোনও আম্মাকে আমাদের মত ভয় পেতাম অবশ্য। কেউ রাতে বাসায় আসা দূরে থাক সন্ধ্যায় আসলেও খবর হয়ে যেত। বেত দিয়ে না মেরে কিভাবে শাসন করা যায় তার প্রামাণ্যচিত্র যেনো!! আমার বড় ভাইকে খেলাধুলায় বেশি সুযোগ না দিলেও ছোট হওয়ার কারণে আম্মা আমার খেলায় খুব কম বাঁধা দিয়েছেন। আমাকে ক্রিকেটের ব্যাট, স্টাম্প কিনে দিয়েছেন। এ যুগের মত কোচিং একাডেমি থাকলে নিয়ে যেতেন নিঃসন্দেহে। আম্মার একটা শখ ছিলো আমরা গান শিখব। প্রথমে অরুন লাল আর পরে শান্ত শেখর ভট্টাচার্য স্যার কে দিয়ে অনেক চেষ্টা করেছেন। সে যুগে আম্মা আমাদের গান শেখায় যে খরচ যেভাবে করেছেন তা অকল্পনীয়! আফসোস আমরা সবাই গান শিখলেও গায়ক গায়িকা হতে পারিনি। আমার ভাই তবলা আর আমি গিটারে হাত বুলিয়েও খুব একটা এগুতে পারিনি। বোনেরা গান জানে।কুলাউড়ায় নব্বুইয়ের দশকের কোন অনুষ্ঠানে আমাদের কোনো বোন নেই, এটা হয়নি। যদিও তারাও এখন আর গান করে না। আম্মার এক গুনের কথা বলতে হলে বলবো নির্লোভ মানুষ। কত কি করতে পারতেন লোভ করলে। আম্মাকে অনেকে কলেজের প্রশাসনের কোন পদে দেখতে চাইতেন না, কারণ অনুমেয়। গভর্নিং বডির মেম্বার যে দু একবার হয়েছেন তাতেও কম ঝামেলা হয়নি। আম্মা নিজেও কখনো চাইতেন না কোনো পদ। আব্বার অসুস্থতার জন্য দায়িত্ব পালনও তাঁর জন্য কষ্টকর ছিলো। নির্লোভ ছিলেন আব্বাও, আমি যতটা দেখেছি। আমার নয় বছর বয়সে স্ট্রোক করা আব্বাকে আমি অতটা চেনার সময়ও পাইনি। আমি আজ লিখতে পারি কারণ আম্মা হাতে ধরে এটা আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। কখনো কলেজে কেউ এলে মানপত্র লিখতে হতো। আম্মা মুখে বলতেন আমি লিখতাম। কখনো কোন অনুষ্ঠানে আম্মাকে দাওয়াত দিলে বক্তৃতা আম্মা লিখে নিয়ে যেতেন, লিখে দিতাম আমি।আম্মা আমাকে বলতেন কি বলা যায় আর আমিও উনাকে পরামর্শ দিতাম।বিতর্ক প্রতিযোগিতার প্রতি আমাকে অসম্ভব উৎসাহ দিতেন আম্মা। স্ক্রিপ্ট লিখতে আমাকে সাহায্য করতেন, লিখে দিতেন না। আর তাই তখন বিরক্ত হলেও এখন বুঝি এভাবেই আমি মাঝে মাঝে মনের ভাবনাগুলো লিখতে শিখেছি। আম্মাকে নিয়ে অনেক লিখবো এটা ভেবে শুরু করে আমি দেখছি এটা অনেক কষ্টকর কাজ। আমার জন্য অসাধ্য। যাই হোক এই সুযোগে আমি কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজের (সাবেক) সকল শিক্ষককে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে চাই।নাম নিবো না কারও, পাছে বাদ পড়ে যায় কোনো শ্রদ্ধেয় নাম।