আপডেট

x


ঢাকা থেকে ব্যাংকক

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মনোরম থাইল্যান্ড

মঙ্গলবার, ১২ জুন ২০১৮ | ১২:৫৮ অপরাহ্ণ | 2894 বার

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মনোরম থাইল্যান্ড

বিশ্বের অন্যতম পর্যটন সমৃদ্ধ দেশ থাইল্যান্ড। সাজানো গোছানো, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মনোরম দেশটি। তাই যেকোনো পর্যটকের জন্যই থাইল্যান্ড ভ্রমণ একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। একজন পর্যটক হিসাবে চেষ্টা করি প্রতি বছর কোন না কোন দেশ বা দেশের যে কোন ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে আসতে। থাইল্যান্ডে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। সেই মতো ঢাকা থাই দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করি। থাইল্যান্ড যাবার এক সপ্তাহ আগে বিমান টিকেট, হোটেল বুকিং সব সম্পূন্ন করে রাখি। এরপর একদিন নয়নাভিরাম দেশটি দেখার জন্য উড়াল দেই থাইল্যান্ড।
হাতে সময় ছিলো কম। তাই ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে ভিসার জন্যে এজেন্সির সহযোগিতা নিয়েছি। এতে খরচ পড়েছে ৪০০০ টাকা, নিজে করলে ৩০০০ টাকাতেই হয়ে যেতো হয়তো। একটু বলে রাখি, অন্যান্য দেশের ভিসার মতো সরাসরি থাই এম্বেসিতে আবেদন করার সুযোগ নেই। ভিসার আবেদন জমা দেয়ার ৩-৪ দিন পর এম্বেসি থেকে ফোন করে সাক্ষাৎকারের জন্যে। সমস্যা হচ্ছে থাই এম্বেসি থেকে আপনাকে একবারই ফোন করা হবে । একবার মানে একবারই । আপনি যে কোনো কারণেই হোক, ফোন রিসিভ করতে না পারলে ভিসা না পাওয়ার সম্ভবনা প্রায় ১০০% ।
সাক্ষাৎকারে আমাকে বেশ কিছু সাধারণ প্রশ্ন করা হয়। যেমন  কত দিনের জন্য যাবো, চাকুরীজীবি হলে অফিস কোথায়, অফিসে কোন পোস্টে আছি (স্টুডেন্ট হলে আইডি কার্ডের নাম্বার), কোথায় থাকবো, কেন যাচ্ছি ইত্যাদি। সাক্ষাৎকারে সন্তুষ্ট হলে ভিসা কোনো কঠিন ব্যাপারই নয়!

สนามบินสุวรรณภูมิ-
শাহজালাল থেকে সূবর্ণভূমি : অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। গত ৩ মার্চ ২০১৮ আমি ঢাকা থেকে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে রওনা হই। শাহজালাল আন্তজার্তিক বিমান বন্দরে ফাইট ছাড়ার প্রায় ৩ ঘন্টা আগে উপস্থিত হলাম। পাসপোর্ট, ভিসা, লাগেজ ইত্যাদি সব চেকিংয়ের পর সকাল ৯টা ২০ মিনিটে বাংলার মাটি ছেড়ে বিমান আমাকে নিয়ে আকাশে ওড়ে। ঢাকা-ব্যাংকক মাত্র আড়াই ঘন্টার উড়াল। কিন্তু ঢাকা থেকে ব্যাংকক সরাসরি যাবে না। তাই চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সাময়িক যাত্রা বিরতি। সেখান থেকে যাত্রী নিয়ে ফের যাত্রা। আধাঘন্টা পর আমাদের বিমানে হালকা খাবার পরিবেশন করা হয়। যাত্রীরা সবাই বেড়ানোর জন্য ব্যাংকক যাচ্ছেন। অনেকই পরিবার বা বন্ধুরা মিলে আনন্দ করতে যাচ্ছেন। আমার বুঝতে বাকি ছিল যে, আজকাল বাংলাদেশ থেকে প্রচুর লোক ভ্রমণের জন্য বাহিরে যান। ফাইটের অভিজ্ঞতা ছিল খুবই মনোরম।
ব্যাংকক সময় দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে বিমান সূবর্ণভূমি বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে। শুনেছি এটি বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক বিমানবন্দর। এতে সব ধরনের সুয়োগ সুবিধা রয়েছে। যাত্রীদের সুবিধার জন্য দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন নির্দেশনা, কোথায় চলমান রাস্তা, কোথাওবা চলমান সিড়ি, ক্যাপসুল লিফট, যে যেভাবে যেতে চায়! বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত বেশ অনেকখানি পথ। কান্তিকর বিমানযাত্রার পর হাঁটতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, দাঁড়িয়ে পড়লাম চলমান রাস্তার উপর, বিনাকেশে পৌঁছে গেলাম জায়গা মতো। বিমান বন্দরের জায়গায় জায়গায় রয়েছে আরামদায়ক সোফা। আছে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা। যাত্রীদের যত রকমের সুবিধা প্রয়োজন সবই আছে এখানে। দেয়ালে লাগানো আছে টেলিফোন, চাইলে কয়েন দিয়ে ফোন করতে পারেন আপনার বন্ধু বা আত্মীয়কে। এক সময় ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠিকতা শেষ করে বাইরে আসি।



1fcc230eedf97cbfc36289a87f515551
প্রথমেই মানি চেঞ্জার থেকে ডলার একচেঞ্জ করে নেই (১ ডলারের বিপরীতে ৩১ বাথ)। পরে মোবাইলের সিম কিনি। ৭দিন, ১৪ দিন বা ৩০ দিন মেয়াদী সিম রয়েছে পর্য়টকদের জন্য। আমি ২৯৯ বাথ দিয়ে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ৭ দিন মেয়াদি সিম কিনি।
বাহিরে গিয়ে ট্যাক্সি জন্য অপেক্ষা করি। আমার হোটেল ছিল সুকুমভিট নানা ছই-৪-এ। যেখানে সব দেশের পর্যটকরা আসে। অনেক ট্যাক্সিও সাথে দামাদামির পর একটা ঠিক করি ৭০০ বাথ দিয়ে। এদেশে বাস, ট্রেন যাত্রাও বেশ আরামদায়ক। প্রথমবার এসেছি, পথঘাট চিনি না, তাই ট্র্যাক্সি নিয়েই হোটেল রওয়ানা দেই। এয়ারপোর্টের আঙ্গিনা পেরিয়ে মেইন রাস্তায় উঠেই ড্রাইভার জিপিএস অন করে দিল। অনেক কান্ত ছিলাম কিন্তু তারপরও অনেক ভালো লাগছিল। গাড়ি চলল আর রাস্তার দু’পাশের আকাশচুম্বী অট্টালিকা দেখতে দেখতে চললাম। পুরো শহরটা দু-তিন তলা ফাইওভার দিয়ে ঘেরা। আমার গাড়িটাও ফাইওভারের উপর দিয়ে চলল। ঢাকার মতো কোথাও কোন জ্যাম নেই। গাড়ি ১০০/১২০ কি.মি. স্প্রিডে চলছে। প্রায় ৪৫ মিনিটি সময় লাগলো হোটেলে পৌঁছতে। তখন স্থানীয় ব্যাংকক সময় বিকালে ৫টা হয়। তাই হোটেলে পৌঁছে একটু বিশ্রাম নেই। সন্ধ্যার পর বের হয়ে রাতের ব্যাংকক শহরের চারপাশ পায়ে হেঁটে দেখে নিলাম। রাতের সৌন্দর্য বেশ মনোমুগ্ধকর। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে ইন্টারনেট থেকে ব্যাংকক ঘুরে বেড়ানোর মতো জায়গাগুলো খুঁজে বের করলাম। অনেক কান্ত ছিলাম, তাই রাতে ভালো একটা ঘুম হলো। পরদিন সকাল থেকে শুরু হলো দর্শণীয় স্থান ঘুরে বেড়ানো। সকাল বেলা হোটেলে বুফেতে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হোটেল থেকে বাইরে একটু হেঁটে ট্যাক্সি নিয়ে শুরু হলো ঘুরে বেড়ানো। এখানে সবই ট্যাক্সি এসি, লাল রঙের।

1024px-Ministry_of_Defence,_Bangkok_-_Day
প্রথমেই গেলাম থাইল্যান্ডের রাজকীয় মন্ত্রিসভার গভর্নর বিভাগে। বিভাগটি জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক সংহতি এবং জাতীয় প্রতিরা বজায় রাখার জন্য রাজকীয় সশস্ত্র বাহিনী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখাÑ রয়েল থাই আর্মি, রয়েল থাই নেভাল ফোর্স এবং রয়েল থাই এয়ার ফোর্স। থাইল্যান্ডের রাজা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান। মন্ত্রণালয় এবং বাহিনী থাইল্যান্ডের মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রতিরা মন্ত্রী, দ্বারা পরিচালিত হয়।
প্রথমে পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখতে শুরু করি। এসব জায়গা ঘুরে দেখতে পর্যটকদের কোন সমস্যা নেই। বরং সাদরে আমন্ত্রন জানাবে সবাই। একা একাও ঘোরা যায়।

DSC_6447
আমি একা একা ঘুরেই ছবি তুলি। আমার নিজের ছবি তোলার জন্য কেউ সাথে ছিল না। তাই যখন যাকে কাছ পাই, তাকেই অনুরোধ করি, আমার একটা ছবি তুলে দিতে। তারাও হাসিমুখেই আমার ছবি তুলে দেয়। হেঁটে হেঁটে পুরো এলাকাটা ঘুরে দেখি। প্রতিরা মন্ত্রণালয়ের প্রবেশ মুখেই রয়েছে সশস্ত্র নিরাপত্তা সৈনিক। একটি কামান রয়েছে, যে কেউ চাইলে তার সামনে থেকে ছবি নিতে পারেন। ন্যাশনাল ডিফেন্সের আশপাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন অনেক প্রশাসনিক ভবন। যা মুগ্ধ করে আমাকে। সেখান থেকে চলে যাই ওয়াট ফো বা ওয়াট পো দেখতে।

bangkok-grand-palace.jpg
ওয়াট ফো মন্দির : বৌদ্ধ মন্দির বা ওয়াট ফো চেপুটান পুরণো বৌদ্ধ মন্দিরের পেছনে অবস্থিত। ব্যাংকক প্রথমবারের মতো এসেছেন, এমন যেকোনও দর্শনার্থীর জন্য তা অবশ্যই দেখা উচিৎ। এটি ব্যাংককের রাজা রামা আই’র রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। মূলত এর নামকরণ করা হয়েছিল ওয়াট পাতারাম বা পাদরাম, যার নাম ওয়াট ফো বা পো। ধারণা করা হয়, রাজা (১৬৮৮-১৭০৩)-এর শাসনামলে প্রাচীন মন্দিরটি নির্মাণ বা সম্প্রসারিত হয়েছিল। বার্মিজের পতনের পর রাজা টাকসিন রাজধানী থানবাউরিতে স্থানান্তরিত করেন। ওয়াট ফো নদীর বিপরীতে ওয়াট অরুণের পাশে অবস্থিত।
১৭৮২ সালে রাজা রামা রাজধানী থানবাউরি থেকে ব্যাংককে স্থানান্তর এবং ওয়াট ফোর পাশে গ্র্যান্ড প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। ১৭৮৮ সালে তিনি ওয়াট ফোর পুরোনো মন্দির পুর্ননিমার্নের নির্দেশ দেন। ১৮০১ সালে, কাজ শুরু হওয়ার বারো বছর পর, জেটওয়ানা বিহারের রেফারেন্সে নতুন মন্দির কমপ্লেক্সের নামকরণ করা হয়। এবং রামার প্রধান মন্দির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরে ২২ একর জমির ওপর মন্দির কমপ্লেক্সের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। বর্তমানে বেশিরভাগ কাঠামোই ওয়াটফোতে নতুন করে নির্মাণ বা পূর্ননির্মাণ করা হয়েছে। মার্বেল চিত্রাবলী এবং শিলালিপিগুলি স্মৃতিসৌধে রতি আছে। বিশ্ব ঐতিহ্য রা, সংরণ ও প্রচারের জন্য ইউনেস্কোর বিশ্ব প্রোগ্রাম এখানে হয়। থাইল্যান্ডের প্রথম ইউনিভার্সিটি এবং ঐতিহ্যবাহী থাই ম্যাসেজের কেন্দ্র হিসেবে ওয়াট ফোকে বিবেচনা করা হয়। এটি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালুর আগে, ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়ে একটি মেডিক্যাল শিণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছিল। আজও ঐতিহ্যবাহী ঔষধের একটি কেন্দ্র এটি। যেখানে ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত থাই ঔষধের জন্য একটি প্রাইভেট স্কুল এখনও চালু আছে।

DSC_6550
শহরের সবচেয়ে বড় মন্দির কমপ্লেক্সের এক এবং এর দৈত্য বিনাশকারী বুদ্ধের জন্য বিখ্যাত, যা ৪৬ মিটার লম্বা এবং স্বর্ণের পাতায় আচ্ছাদিত। কারণ এখানে সোনার বুদ্ধ এমনকি জনপ্রিয় জিনিস রয়েছে। দেখা যায়, অনেক মানুষ সারাদিনের কান্তি শেষে বিশ্রামের জন্য একটু বসছেন এখানে। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী থাইয়ের একটি মহান জায়গা। মন্দিরের প্রবেশ পথ ১০০ বাথ এবং সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। গোল্ডেন বুদ্ধ, রেডিসিনেশন বুদ্ধ, মার্বেল টেম্পল ও রতœ গ্যালারির রয়েছে। এ মন্দিরে ঢুকতে হলে উপযুক্ত পোশাক পরতে হয়; শর্ট প্যান্ট, শর্ট টি শার্ট, শর্ট জিন্স (মেয়ে), শর্ট টপসÑ এগুলো পরে ঢোকা নিষেধ। তাই কেউ যদি এগুলো পরেও যান, তাহলে উপযুক্ত পোশাক কিনে ঢুকতে হবে।
ওয়াট ফোতে ভাল ইংরেজি ভাষাভাষী গাইড রয়েছে, যারা প্রায় ২০০ থেকে ৪০০ বাথ নেবে। সবচেয়ে ভালো হয় কোন গ্রুপের মাধ্যমে ট্যুর করলে।
বিশাল বৌদ্ধ মন্দির সবাইকে মুগ্ধ করে। এখানে বৌদ্ধ সোনার তৈরি। কোনও সিকিউরিটি চেক বা ছবি তোলায় কোন বাধানিষেধ নেই। এ দেশের মানুষ ট্যুরিস্টদের প্রচ- বিশ্বাস করে। তাই দেশটা সবদিক থেকে এতো এগিয়ে। আমি ১০০ বাথ দিয়ে টিকেট করে ভেতরে ঢুকি। শায়িত বুদ্ধ বা রিকাইনিং বুদ্ধর ছবি পত্রপত্রিকায়-ইন্টরনেটে আগেই দেখেছি। কিন্তু এর বিশালত্ব, সেটা চোখের সামনে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! মন্দির চত্বরও বিশাল। এটি থাইল্যান্ডের প্রাচীনতম মন্দিরগুলির অন্যতম। রাজা তৃতীয় রামের সময়কালে এ মন্দিরটি নতুন করে সাজানো হয়। মন্দিরের ভেতরে দানপাত্রে পয়সা ফেলার অদ্ভুত আওয়াজ মাদকতা সৃষ্টি করে। থাম ও দেয়ালে কারুকার্যময় মূর্তি।

DSC_6531
ভেতরেই খাবার দোকান আছে। খাবার সময় হয়ে যাওয়ায় সেখানেই খেয়ে নেই। টিকেটের সাথে পানি ফ্রি। প্রচন্ড গরম ছিল সেদিন। তাই সে পানিটি বেশ কাজে আসে, না হয় ২০ বাথ দিয়ে কিনতে হতো। অনেক রোদের তাপ, তা গায়ে না মেখেই ঘুরতে হয়েছে আমাকে। বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে এলাকাটি দেখি এবং অনেক ছবি তুলি।
মন্দিরের বাইরে এসে দেখি অনেকেই ছাতা বিক্রি করছে আকারে-ইঙ্গিতে, ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে চলছে দরদাম করছে স্থানীয় লোকজন। আস্তে আস্তেÍ দোকানপাট দেখতে দেখতে চলে যাই গ্রান্ড প্যালেসের দিকে।
তার আগে একবার দেখে যেতে পারেন ওয়াট ফ্রা কাইয়ো। এটি ওয়াট ফো পাশে অবস্থিত। ওয়াট ফ্রা কাইয়ো বা এমারেল্ড বৌদ্ধ মন্দির থাইল্যান্ডের সবচেয়ে পবিত্র বৌদ্ধ মন্দির হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি ব্যাংককের ফ্রা নাখন জেলায় অবস্থিত। এ মন্দিরটি গ্র্যান্ড প্যালেস কমপ্লেক্সের মধ্যে অবস্থিত এবং এমারেল্ড বৌদ্ধের বাড়ি, পনের শতাব্দী থেকে কেবল একটি জ্যাড পাথর থেকে ধ্যানরত অবস্থানের একটি গাঢ় সবুজ বর্ণেও বৌদ্ধ মূর্তি খোদাই করা আছে।

1200px-Grand_Palace_Bangkok,_Thailand
গ্র্যান্ড প্যালেস : নাম শুনলেই শিহরণ জাগে। দূর থেকে দেখেই শুরু হয় ভালোলাগা। কাছে গেলে সেই ভালোলাগা বাড়তেই থাকে। স্থাপত্যকর্ম সৃজনশীলতার অন্যতম প্রতিমা, যার প্রতিফলন মিলবে থাইল্যান্ডের গ্র্যান্ড প্যালেস বা মহা প্রাসাদে। গ্র্যান্ড প্যালেস থাই স্থাপত্যশৈলীর সর্বোচ্চ প্রতীক। ওয়াট ফো থেকে গ্রান্ড প্যালেসে যেতে একটু পাঁয়ে হাঁটতে হয়। চাইলে টুকটুক নিয়েও যাওয়া য্য়া। টুকটুক আমাদের দেশের সিএনজির মতোই দেখতে, কিন্তু ভাড়া অনেক। আমি হেঁটেই গ্রান্ড প্যালেসে যাই। যেতে যেতে চারপাশ দেখতে দেখতে যাই। রাস্তার ম্যাপ দেখে দেখে অনেক বিদেশি পর্যটক হেঁটে চলেছেন। রাস্তার পাশে অনেক খাবারের দোকান। বিশেষ করে ফলের দোকান অনেক বেশি। তাছাড়া অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসও পাওয়া যায়।
গ্র্যান্ড প্যালেসের মুখেই অনেক কাপড়ের দোকান। এখানেও ঢুকতে হলে উপযুক্ত পোশাক পরতে হবে। শর্ট প্যান্ট, শর্ট টি শার্ট, শর্ট জিন্স (মেয়ে), শর্ট টপস এগুলো পরে ঢুকতে মানা। টাকা চেঞ্জ করার জন্য প্রতিটি পয়েন্টে রয়েছে এক্সচেঞ্জ কাউন্টার। তাই কোন অসুবিধা নেই।

5
লাইনে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধভাবে গ্রান্ড প্যালেসে ঢুকতে হবে। এখানে সহযোগিতার জন্য রয়েছে রয়েল থাই পুলিশ। ভেতরে ঢুকেই দেখি এর মধ্যেই অনেক পর্যটকে সমাগম হয়েছে। অনেকে গ্রুপ ট্যুরে এসেছে। সবাই মিলে ছবি তুলছে। আমি নিজে কয়েকটা সেলফি তুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাই টিকেট করার জন্য। টিকেট কাউন্টার থেকে মূলভবনে ঢোকার জন্য ৫০০ বাথ দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করি। পরে মূল ভবনের গেটে টিকেট চেক করে ভেতরে প্রবেশ করি। মূল ভবনে ঢুকতেই মনেস্ট্রির মধ্যে ম্যুরালের অনন্য কাজ দেখা যায়। ভেতরের আলো-আবছায়া পরিবেশ মনকে যেনো কোন সুদূর অতীতে নিয়ে যায়। সময় অল্প, বিকেল হয়ে যাচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাবে তাই দ্রুততার সাথে প্রাসাদ দেখতে শুরু করলাম। এতো রঙের বাহার চারদিকে! মনেই হয় না পৃথিবীতে ‘মন খারাপ করা বিকেলের’ কালো মেঘ থাকতে পারে। গাঢ় সুনীল আকাশও আমার সারাদিনের বেড়ানোর সঙ্গী। চমৎকার ঐতিহাসিক ভবন কমপ্লেক্স সত্যিই সবচেয়ে জাঁকজমক কাঠামোর মধ্যে একটি, যা আপনি ব্যাংককে এলে খুঁজে পাবেন। এটি থাইল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোর একটি। স্থাপত্য সৌন্দর্য ও প্রাচীণ মূল্যবান সংস্কৃতির জন্য ব্যাংকক একটি আবশ্য দর্শনীয় স্থান।
গ্র্যান্ড প্যালেসের প্রতিষ্ঠা ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে, থাই রাজা প্রথম রামা পুথায়োতফার হাতে। নানা কারণে পুরনো রাজধানী থন বুড়ি থেকে নতুন রাজধানী ব্যাংককের চাও প্রায়া নদী তীরে প্রতিষ্ঠিত হয় এ মহাপ্রাসাদ। এরপর থেকে একটানা দেড়শ বছর এ প্রাসাদই ছিল থাই রাজ পরিবারের বাসস্থান ও প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু। রাজপ্রাসাদ ছাড়াও প্রাসাদ এলাকায় ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, উপাসনালয় ও শিা প্রতিষ্ঠান। প্রাসাদের মূল অংশে ঢুকতেই চোখে পড়লো পাহারারত দানবাকৃতির গারুদা-মূর্তি। গারুদা হচ্ছে পৌরাণিক চরিত্র, যা শক্তির প্রতীক। আছে রামায়ণের কাহিনী সংবলিত সুনিপুণ দেয়ালচিত্র।

DSC_6623
চোখ ধাঁধানো কারুকার্য় খচিত সব স্থাপনা! কোনোটা রাজদরবার, কোনোটা উপাসনালয়, থাকার ঘর, গ্রন্থাগার, শিা প্রতিষ্ঠান, সভা-সম্মেলন ক। প্রাসাদ-চৌহদ্দির প্রতিটি স্থাপনাই অতুলনীয়, স্থপতি-শিল্পীরা যেনো তাদের সৃজনশীলতা ফুটিয়ে তুলতে যেনো কোনো কার্পণ্য করেননি! তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে মূল উপাসনালয়টি, যেখানে অধিষ্ঠিত পান্নার তৈরি বৌদ্ধমূর্তি, থাই ভাষায় যার নাম ‘ওয়াত প্রা ক্যাও’। সাধ ও সাধ্যের সুসমন্বয় ঘটিয়েই দেশি-বিদেশি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এ বৌদ্ধমূর্তি দর্শনে আসেন। আর সাধারণ পর্যটকদের কাছে এর আকর্ষণতো বহুমাত্রিক।
মহাপ্রাসাদের কিছু স্থাপনায় রয়েছে থাই ও ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর মিশেল। যা রাজদরবার ও প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য ১৯ শতকে প্রতিষ্ঠা করেন থাই রাজা পঞ্চম রামা চুলালংকর্ন। এ গ্র্যান্ড প্যালেসটিতে প্রায় ৩৫টি আকর্ষণ রয়েছে। সেগুলির মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকটি হলো : ওয়াত ফ্রা শি রাট্টানা সাতসাদারাম বা ওয়াত কায়েও বা চ্যাপেল রয়্যাল বা এমারেল্ড বুদ্ধ। বুদ্ধের মূর্তির কেন্দ্রীয় গৃহস্থলের দেয়াল মূল্যবান পান্না পাথর দিয়ে শোভিত। মন্দিরের মিউজিয়ামের একতলায় বিভিন্ন শিল্পকর্মের প্রদর্শনী রয়েছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সভাগৃহটি সাদা হাতির অস্তির প্রদর্শন করা হয়। এই হাতিগুলির গোলাপী রং-এর কোমল চোখ ছিল। এগুলো রাজপদের এক অপরিহার্য় প্রতীক ও তাদের সম্পদ রাজার খ্যাতিকে প্রভাবিত করেছিল; যার যতো সাদা হাতি, তাঁর ততো প্রতিপত্তি! রাজ্যাভিষেকের পটমন্ডপ, রাজকীয় অলংকরণ ও মুদ্রা যাদুঘওে মুদ্রা, রাজপোশাক, অলঙ্কারাদি, রাজদরবারে ব্যবহৃত রাজকীয় অলংকরণ প্রদর্শিত হয়।

DSC_6582
ফ্রা থিনাঙ্গ আমারিন উইনিটচাই মাহাই সূর্য ফিমান লো এ ভবনটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ইমারত। থাই শৈলীর সিংহাসন সভাগৃহটি বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য নির্মিত হয়েছিল। গ্র্যান্ড প্যালেস ভবনের আরোও অন্যান্য আগ্রহদীপ্ত পরিদর্শনমূলক স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ রাজ পরিবারের দপ্তর, সালা লুক খুন নাই, সালা সাহাথাই সামাখোম, সিওয়ালাই বাগিচা, হো শাস্ত্রখোম, হো সুলালাই ফিমান এবং হো ফ্রা দেট মোন্তিয়েন।

DSC_6572
মজার ব্যাপার হলো, বর্তমানে এ প্রাসাদে রাজ পরিবারের কেউ থাকেন না, প্রশাসনিক দপ্তরও আর নেই। এটি বর্তমানে ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান ও তীর্থত্রে, শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় বিশেষ কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিদেশি পর্যটকরা এটি সবচেয়ে বেশি পরিদর্শন করেন এবং তাদের কাছে এটি সবচেয়ে স্মরণীয় একটি ল্যান্ডমার্ক। তাই থাইল্যান্ড ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকদের কাছে অবশ্য-দর্শনীয় স্থান এটি। গ্র্যান্ড প্যালেস সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্যালেসে প্রবেশের টিকিটের মূল্য মাথাপিছু ৫০০ বাথ (বিদেশি পর্যটকের জন্য)। এখান থেকে আপনার পরবর্তী গন্তব্য হতে পারে ব্যাংকক জাতীয় জাদুঘর। (চলবে)

মন্তব্য করতে পারেন...

comments

deshdiganto.com © 2019 কপিরাইট এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত

design and development by : http://webnewsdesign.com