মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার প্রতিবেদন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি
- আপডেটের সময় : ০৬:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ মার্চ ২০১৯
- / ৯৮৪ টাইম ভিউ
দেশদিগন্ত নিউজ ডেস্কঃ বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘পক্ষপাতমূলক’ আখ্যা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বিশ্ব মানবাধিকার-২০১৮ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে দাবি করা হয়েছে।
এছাড়া রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, বাকস্বাধীনতায় বাধা, দুর্নীতি ও এনজিও আইনে থাকা ‘অতিরিক্ত কড়াকড়িকে’ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়েছে সরকার।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার ও তাদের দ্বারা সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের তদন্ত এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার খুব কমই কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে।
একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোয় সরকারের প্রশংসাও করা হয়েছে প্রতিবেদনে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবছর মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সামনে বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি উপস্থাপন করে।
এতে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০০ দেশ ও অঞ্চলের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং শ্রম অধিকার সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরা হয়। বুধবার রাতে (বাংলাদেশ সময়) মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ৪৩তম এ মানবাধিকার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গত এক বছরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উল্লেখ রয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় সরকার কাঠামোর কথা উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর দফতরের হাতে।
ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো পাঁচ বছর মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসেছে। এ নির্বাচন কোনো বিবেচনাতেই অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। একই সঙ্গে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা, বিরোধী দলের ভোটার ও পোলিং এজেন্টদের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো নানা অনিয়মের অভিযোগও পাওয়া গেছে।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় হয়রানি, হুমকি, গ্রেফতার ও সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে, যা বিরোধী দল ও তার সমর্থকদের স্বাধীনভাবে প্রচার ও সমাবেশে বাধা সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতি জরুরি ছিল, অথচ সঠিক সময়ে তাদের বাংলাদেশে প্রবেশের ভিসা দেয়া হয়নি।
নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক গোষ্ঠীর ২২টি সংস্থার মধ্যে মাত্র ৭টি অভ্যন্তরীণভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছে। শুধু জাতীয় নির্বাচনেই নয়, গত বছর গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও বিরোধী প্রার্থী ও সমর্থকদের হয়রানি, গ্রেফতার, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া এসব নির্বাচনেও ভোট কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার ও কারাদণ্ড দেয়ার কথাও বলা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বন্দিত্ব ও আটকের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে বিরোধীদলীয় সদস্যদের অনেক সময় গ্রেফতার ও বিচার করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির জবাবে অনেক মিথ্যা অভিযোগেও এমনটা করা হয়েছে। সারা বছর খেয়ালখুশিমতো গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিএনপি দাবি করেছে, গত বছর তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির দায়ে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ আইন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তাকে অভিযুক্ত করার জন্য প্রমাণের অভাব ছিল। তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই এ রায় দেয়া হয় বলে জানান তারা।
তার জামিন পাওয়ার আবেদনে আদালত ধীরগতিতে অগ্রসর হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, খালেদা জিয়ার রায়ের সময় মাত্র ৮ দিনে প্রায় ১,৭৮৬ বিএনপি কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনের আগের তিন মাসে বিএনপির ৪,৪২৯ সমর্থকের বিরুদ্ধে প্রায় ৪ লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫টি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। তারা বলেছেন, এটা হল নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে বিরোধীদলীয় এ নেতাকে সরিয়ে রাখার জন্য একটি রাজনৈতিক পটভূমি।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : সন্ত্রাস দমনের জন্য সারা বছর অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের অভিযানেই জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিহত হয়েছে ৪ শতাধিক ব্যক্তি। এছাড়া বছরজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে প্রায় ২৩০ জন সন্দেহভাজনকে হত্যা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
গ্রেফতার করা হয়েছে আরও ১৭০০০ জনকে। মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার এসব হত্যাকাণ্ডকে ‘ক্রসফায়ারে হত্যা’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ আখ্যা দেয়। আর মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমগুলো একে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতার অপব্যবহার করে সন্দেহভাজনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন চালায়।
কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সরকার খুব কম পদক্ষেপই গ্রহণ করেছে। মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীলসমাজ বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গ্রেফতার নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। তাদের দাবি, এদের মধ্যে অনেকেই নিরপরাধ।
গুম ও অপহরণ : মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমের দেয়া তথ্যমতে, গুম ও অপহরণের ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। এর বেশির ভাগের সঙ্গেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত। এসব ঘটনা রোধ ও তদন্তে সরকারি উদ্যোগ তেমন ছিল না। অধিকার জানিয়েছে, গত বছর জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮৩টি গুমের ঘটনা ঘটেছে।
কারাগারে নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ : আইনে আটকাবস্থায় সব ধরনের নির্যাতন ও অমানবিক আচরণ বা শাস্তিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে। তারপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত।
তারা সাধারণত সন্ত্রাসী ও বিরোধী দলের কর্মীদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার জন্য নির্যাতন করে থাকে। অপহরণ, হুমকি, বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতনের মতো ঘটনায়ও সরাসরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই জড়িত।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা ধর্ষণ ও যৌন হয়রানিও করে থাকে। অধিকার জানিয়েছে, গত বছরের প্রথম ১০ মাসে অন্তত ৫ বন্দি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে মারা গেছে।
গত বছরের ৪ মে অপহরণের অভিযোগে আশরাফ আলী নামে এক ব্যক্তিকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেফতারের ৩৫ ঘণ্টা পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তিন ঘণ্টা পর হাসপাতালে মারা যান আলী।
ময়নাতদন্তে তার শরীরের নিুাংশে থেঁতলানোর চিহ্ন পাওয়া গেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, ময়নাতদন্তে আলীকে স্বাভাবিক মৃত্যু দেখানোর জন্য চিকিৎসকদের চাপ দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বাংলাদেশের কারাগারের দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, কারাগারগুলোয় ধারণক্ষমতা থেকে অতিরিক্ত আসামি রাখা হয়েছে। সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা নেই। শৌচাগার সুবিধারও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এ ধরনের পরিবেশের কারণে গত বছর ৭৪ কয়েদি মারা গেছেন।
বিচারবহির্ভূত গ্রেফতার : ১৯৭৪ সালের স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষ চাইলেই ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। প্রায়ই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেফতারের পেছনে এ আইন দেখিয়ে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী, আটক কেউ তাকে গ্রেফতারের কারণের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
কিন্তু সরকার সাধারণত এ ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করে না। শুধু সন্ত্রাসী নয়, এমনকি সুশীলসমাজ, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও বিরোধী নেতাদেরও সরকার জোরপূর্বক গুম করছে বলে অভিযোগ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে : প্রদিবেদনে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলছে। কিন্তু তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধ ও দুর্নীতির তদন্ত ও বিচার খুব কমই করে থাকে সরকার। যদিও সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ, তাদের শৃঙ্খলা ও দায়িত্ব-কর্তব্য উন্নয়ন এবং দুর্নীতি দমনে ক্রমাগত পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিচার বিভাগ নামমাত্র স্বাধীন : প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাধীন বিচারের জন্যই আইন; কিন্তু দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সেই স্বাধীনতাকে খর্ব করে। বিচারককে অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে থাকবে- ২০১৪ সালে এ সংক্রান্ত সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী পাস করে পার্লামেন্ট।
২০১৭ সালে সুপ্রিমকোর্ট একে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। এতে সরকার ও সুপ্রিমকোর্টের মধ্যে দ্বন্দ্বে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে পদত্যাগ করতে হয়।
গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতায় বাধা দেয়ার কথা বলা হয়েছে এ রিপোর্টে। এতে বলা হয়, ২০১৬ সালে প্রণীত তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) কারণে সাংবাদিকরা হয়রানির ভয়ে সেলফ-সেন্সরশিপের দিকে ঝুঁকছে। প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়া সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
যেসব গণমাধ্যম সরকারের সমালোচনা করে থাকে, তারা নানাভাবে সরকারের নেতিবাচক চাপের মুখে পড়ে। টেলিভিশন চ্যানেলের লাইসেন্সের বিষয়টিও সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রিত। এছাড়া সাংবাদিকদের আক্রান্ত হওয়ার কথাও বলা হয় প্রতিবেদনে।
রিপোর্টার উইদাউট বর্ডারের বরাত দিয়ে বলা হয়, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় ২৩ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছিলেন। এছাড়া ৫ ফেব্রুয়ারি ফটোসাংবাদিক শহিদুল আলমকে আটকের বিষয়টিও উল্লেখ করেছে মর্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা : বছরজুড়ে বিএনপিকে কোনো মিছিল ও সমাবেশ করতে দেয়নি সরকার। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গত বছরের মার্চের ১১, ১৯ ও ২৯ তারিখে বিএনপির সমাবেশ করার আবেদন বাতিল করা হয়েছে।
কারণ হিসেবে নিরাপত্তাজনিত কারণ উল্লেখ করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়ই সমাবেশের জন্য ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বিএনপিকে তখন অন্য স্থানে সমাবেশ করতে বাধ্য করা হয়।
বিএনপি জানিয়েছে, ১ সেপ্টেম্বর মৌখিকভাবে তাদের সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। একই সঙ্গে ১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তারা মানববন্ধন করেছিল।
এ দুই কর্মসূচিতে দলটির শত শত নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনপি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো বছরজুড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ তাদের পছন্দমতো সব স্থানে সমাবেশ করেছে।
১৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তিনি সব দলকে সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশের অনুমতি দিতে ডিএমপি কমিশনারকে নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর ২৯ সেপ্টেম্বর ডিএমপি ২২টি শর্তে বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দীতে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। সুত্রঃ যুগান্তর