বিএনপি থেকে পদত্যাগ করতে পারেন এই ৫ নেতা
- আপডেটের সময় : ০৪:৫২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ নভেম্বর ২০১৯
- / ৪০৯ টাইম ভিউ
বিএনপি ছেড়েছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিএনপি করে আসা এই জ্যেষ্ঠ নেতার পদত্যাগের পরদিনই দল ছাড়ার খবর আসে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানে। শুধু তাই নয়, আরও অন্তত ৫-৭ জন সিনিয়র নেতার বিএনপি ছাড়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছেন, যাদের ৫ জনই ভাইস চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন।
বিগত কয়েক বছরে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী, মোসাদ্দেক আলী ফালু, ইনাম আহমেদ চৌধুরীর পর মঙ্গলবার বিএনপি ছাড়েন আরেক ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান। মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের কেউ প্রথমবারের মতো দল ছাড়লেন।
তিনি দলের সব ধরনের পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বরাবর লেখা চিঠি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। সাবেক এই সেনাপ্রধান বুধবার রাতে পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার কথা জানিয়েছেন। তবে এর কিছুক্ষণ পরই তার স্ত্রী বলেন, দল থেকে পদত্যাগের বিষয়টি গুঞ্জন।
দুদিনে দুই জ্যেষ্ঠ নেতার পদত্যাগের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন চলছে যে আরও অন্তত ৫-৭ নেতা বিএনপি ছাড়ছেন। এদের মধ্যে আছেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী। এছাড়া আরেক ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান দলে স্থায়ী কমিটির সদস্যপদ না পেয়ে হাইকমান্ডের ওপর ক্ষুব্ধ আছেন। দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে জায়গা না হলে তিনিও পদত্যাগ করতে পারেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
সবশেষ বিএনপির স্থায়ী কমিটির শূণ্য পদে জায়গা হয়েছে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান টুকুর। স্থায়ী কমিটিতে উল্লেখিত নেতাদের নাম বহু দিন ধরেই ঘুরেফিরে আসছিল। কিন্তু তাদের সেই মূল্যায়ন এখনও করা হয়নি। এ কারণে তারা দলের হাইকমান্ডের ওপর ক্ষুব্ধ।
দলীয় সূত্রে আরও জানা যায়, অবমূল্যায়নের কারণে চট্টগ্রামের আরও একজন নেতা ও বরিশালের এক নেতাও পদত্যাগ করতে পারেন। তারা দু’জনই বিএনপির কেন্দ্রীয় সিনিয়র নেতা।
তবে পদত্যাগের বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে এসব নেতা বলেন, এটা গুঞ্জনই। এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে দল পরিচালনায় স্থায়ী কমিটির নেতা ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের সঙ্গে কোনো আলোচনাও হয় না। যদিও স্থায়ী কমিটির পর ভাইস চেয়ারম্যানরাই বিএনপির সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ।
বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে বলেন, দলের কোনো সিদ্ধান্তই জানতে পারি না। প্রতিদিন শুনতে পাই নয়াপল্টনে স্কাইপে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের নিয়ে ডেকে ডেকে কথা বলেন। কী বলেন, কী সিদ্ধান্ত নেন তাও জানি না। দলে আছি কী নেই তাও জানি না।
এমতাবস্থায় চারদিকে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে, বিএনপি থেকে ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাজাহান ওপর বীরউত্তম, মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ বেশ কিছু সিনিয়র নেতা যে কোনো সময় পদত্যাগ করছেন। যদিও এসব নেতার মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গতকাল বৃহস্পতিবার দলীয় কর্মসূচিতে দেখা গেছে।
এ বিষয়ে আলতাফ হোসেন চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আরও অনেক সাংবাদিক আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। এর পর আমি নিজে থেকে অনেক নেতার সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই বলেছে ‘এটি ভুয়া খবর।’
দলের মধ্যে যে ক্ষোভ বিরাজ করছে তা কীভাবে দূর করা সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্ষোভ দূর করা সম্ভব নয়; ক্ষোভের কারণ দূর করতে হবে।
সম্প্রতি এক মামলায় হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি আদালত থেকে জামিনেও মুক্ত হন। এর পর এক অনুষ্ঠানে তিনি অভিযোগ করে বলেন, রিজভী (বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী) ছাড়া কেউ তার অথবা তার পরিবারের খোঁজ নেননি। দলের নেতাদের সহমর্মিতাবোধ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
বিএনপি পোড় খাওয়া নেতাদের একজন আবদুল্লাহ আল নোমান। চট্টগ্রাম বিএনপির সবচেয়ে সিনিয়র নেতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা দেয়া হয়নি। দুই দুবার কাউন্সিলে চট্টগ্রাম থেকে দুই নেতাকে (সালাউদ্দিন কাদের ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী) স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয়েছে যারা একসময় অন্য দল করতেন। তারা রাজনীতিতেও নোমানের জুনিয়র। এ কারণে নোমান ক্ষুব্ধ।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে রাজপথে দৃশ্যমান আন্দোলন কর্মসূচি না দেয়া, খালেদা জিয়াকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ, ‘অকারণে’ মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়া ও দল পুনর্গঠনসহ দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে সিনিয়র নেতাদের অবজ্ঞা, সম্প্রতি অভিজ্ঞদের বাদ দিয়ে দুই নেতাকে স্থায়ী কমিটিতে নিয়োগ দেয়া নিয়ে মান অভিমান চলছে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে। এসব ক্ষোভের পাশাপাশি নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা ও মামলা-হামলা থেকে রক্ষা পেতেও কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে ক্ষোভ ও অভিমানে ভাইস চেয়ারম্যান এম মোরশেদ খান বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাকে গত নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়নি। দক্ষিণ চট্টগ্রামের জেলা কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ সভাপতি আবু সুফিয়ানকে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিলেন মোরশেদ খান।
আর মাহবুবুর রহমান পদত্যাগের বিষয়ে বলেছেন, আমি বয়স্ক মানুষ। সামনের ডিসেম্বরে ৮০ বছর পূর্ণ হবে। রাজনীতিতে কনট্রিবিউট করার মতো আমার কিছু নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সূত্র আরও জানায়, মাহবুবুর রহমানের পদত্যাগের পেছনে অন্যতম কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি বিরোধিতা করা। গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়ে মন্তব্য করেন। যদিও এরপর সাবেক এই সেনাকর্মকর্তা স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিতেন।
গত জানুয়ারিতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে মাহবুবুর রহমান অভিযোগ করেন, একাদশ নির্বাচনে গিয়ে বিএনপি ভুল করেছে। যদি দলের নেতৃত্ব দিতে হয়, তারেক রহমানকে দেশে আসতে হবে। দেশে এসেই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বিদেশ থেকে দলের নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে জানতে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও বিএনপির মহাসচিবকে পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমি তাদের পদত্যাগের বিষয়টি জানি না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দলে সব সময় সব কিছু আমার অনুকূলে থাকবে এটি ভাবা ঠিক নয়। প্রতিকূল অবস্থাও আসবে। এটি মোকাবিলা করাই রাজনীতি। যারা পদত্যাগ করছেন, তা ব্যক্তিগত স্বার্থে। এখানে আদর্শের কোনো বিষয় নয়। যেমন আমি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলাম। দল তখন আমার কথা শোনেনি, একসময় তো আমার কথা শুনতে পারে। ক্ষোভ প্রকাশ করে পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়।’
এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির যৌথ নেতৃত্বে দলের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এখানে তারেক রহমান এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। সেখানে কেউ যদি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর অহেতুক দোষ চাপান সেটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে দলের বিপদে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছেন না। বেইমান তকমাও লাগাতে চাইছেন না।
ওই সব নেতা বলেন, অবস্থা এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে পদত্যাগ করলে নেতাকর্মী ও দেশের মানুষের কাছে তাদের বেইমান হতে হবে। আবার যেভাবে দল চলছে, তাতে সম্মান নিয়ে রাজনীতি করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। এ কারণে ছন্দপতন ঘটতে চলেছে বিএনপিতে।