বাংলাদেশের চামিন্দা ভাসের গল্প
- আপডেটের সময় : ০১:২৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০১৯
- / ১৫০৫ টাইম ভিউ
মাজিদ ফাহিমঃ সৈয়দ রাসেল, বাংলাদেশ ক্রিকেটের এক হতাশা কিংবা দুঃখের নাম। যোগ্যতার মূল্যায়ন কিংবা সুযোগ পেলে যিনি এখনো মাঠ মাতাতে পারতেন লাল-সবুজের জার্সি গায়ে। বাংলাদেশ ক্রিকেটে হারিয়া যাওয়া তারা অনেক। অনেক স্বপ্ন,সম্ভাবনা,আশা নিয়ে অনেকেই দেশের হয়ে পথচলা শুরু করেছিলেন বাইশ গজের দুনিয়ায়,সেই পথচলায় বেশি দূর আগাতে পারেননি এমন সংখ্যাও কম নয় বাংলাদেশ ক্রিকেটে।
শুরুর সাথে সাথেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা থমকে গিয়েছিলো এমন তালিকা করতে গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটে সৈয়দ রাসেল নামটা উপরের দিকেই থাকবে। বোলিং এ খুব বেশি গতি ছিলো না তবে সুইং করাতে পারতেন দু’দিক থেকেই। রান আটকে রেখে প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলে প্রয়োজনের সময় ব্রেক থ্রু এনে দিতে পারতেন। সুইং এবং লাইন লেন্থের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিলো দারুন।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে তখন বোলিংয়ের নেতৃত্ব দিতো স্পিনাররা। স্পিনারদের প্রাধান্য দিয়ে একাদশ সজানো হতো। বিশ্ব ক্রিকেটেও বাংলাদেশ স্পিনারদের দেখা হতো সমীহের চোখে। সেই জায়গা থেকে মাশরাফির সাথে জুটি বেধে সৈয়দ রাসেল আস্তে আস্তে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাড়ান,সুযোগ পেতে থাকেন নিয়মিত একাদশে।
বিকাশ রঞ্জন নাথ এবং মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু এর পর তৃতীয় কোনো বাহাতি বোলারের সন্ধান পায় বাংলাদেশ সৈয়দ রাসেলের অভিষেকের মাধ্যমেই।
২০০৫ সালে বিসিবি ২৫ জন সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারের তালিকা করে। পরবর্তীতে এই ২৫ জনকে প্রশিক্ষণ এর জন্য পাঠানো হয় অস্ট্রেলিয়ায়। সেই ২৫ জনের তালিকায় সৈয়দ রাসেল নামটাও ছিলো। অস্ট্রেলিয়ার ও সেই সময় ক্রিকেটে স্বর্ণযুগ চলছিলো।
অস্ট্রেলিয়া দলের সদস্য এবং ঐ সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান জাস্টিন ল্যাংগার কে আউট করতে ভীষন হিমশিম খেতে হতো বোলারদের। প্রশিক্ষন চলাকালীন অবস্থায় সেই জাস্টিন ল্যাংগারকে সব মিলিয়ে ৪ বার আউট করেন সৈয়দ রাসেল।
২১ বছরের আনকোরা কোনো এক তরুন তার সহজাত সুইং দিয়ে জাস্টিন ল্যাংগার কে ৪ বার আউট করে ফেলাটা তখনকার জন্য সহজ কোনো বিষয় ছিলো না। ল্যাংগার তখন সৈয়দ রাসেলকে তুলনা করেছিলেন শ্রীলংকান কিংবদন্তী চামিন্দা ভাস এর সাথে।
প্রশিক্ষণ শেষে সৈয়দ রাসেল ডাক পান বাংলাদেশ এ দলের হয়ে। কাউন্টি ক্ল্যাব কেন্টের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের একটি ম্যাচে ১০ টি এবং পুরো সফরে ২০ টি উইকেট নিজের করে নিয়ে নির্বাচক মন্ডলীর সুনজরে চলে আসেন।
চমকে দেওয়া পারফরম্যান্সের সুবাদে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীলংকার বিপক্ষে রঙিন এবং সাদা উভয় জার্সিতেই অভিষেক হয় এই বাম হাতি পেস বোলারের। অভিষেক ওয়ানডে তে ৪২ রানের ২ উইকেট নেন,উইকেট সংখ্যা অবশ্য সে ম্যাচে আরো বাড়তে পারতো যদি না দুটি ক্যাচ ড্রপ হতো।
তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের বাকি দুই ম্যাচে নেন আরো এক উইকেট। একই সফরে টেস্ট অভিষেকটাও হয়ে যায় এবং ওয়ানডে ম্যাচের মতো দু উইকেট দখল করেন অভিষেক টেস্টে।
তবে ক্যারিয়ার সেরা টেস্ট বোলিং করেন তিনি দ্বিতীয় ম্যাচে। জয়সুরিয়া,সাঙ্গাকারা,সামারিবাদের উইকেট নিয়ে মোট ৪ উইকেট দখল করেন। বোলার সৈয়দ রাসেলের শ্রীলংকা সফর দারুন কাটলেও সব ম্যাচ হেরে যাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য সফরটা ছিলো হতাশার,লজ্জার।
সৈয়দ রাসেল যখন খেলতেন তখন বাংলাদেশ বড় দলগুলোর সাথে হারতো নিয়মিত,জিততো কালেভদ্রে অঘটন ঘটিয়ে। তার সময়ে বাংলাদেশ বড় দলগুলোর বিপক্ষে যে জয় গুলো পেয়েছিলো সে ম্যাচ গুলোতে রাসেল পারফর্ম করেছেন,জয়ী ম্যাচ গুলোতে অবদান রেখেছেন দারুনভাবে। কিন্তু খুব কম সময়ই পেরেছেন আলোটা নিজের দিকে টানতে। অন্যান্যদের পারফর্মের ভীড়ে তার পারফর্ম্যান্স থাকতো ছায়া হয়ে।
বগুড়ায় যখন বাংলাদেশ দল ২০০৬ সালে শ্রীলংকাকে প্রথম বারের মতো হারায় ওয়ানডেতে,সেই ম্যাচের কথা মনে হলে আমাদের মাথায় আসে শেষের দিকে আফতাবের ২১ বলে ৩২ রান করা আক্রমণাত্মক ইনিংসের কথা,কিন্তু বোলিংয়ে দশ ওভারে ২৮ রান দিয়ে দুই উইকেট পাওয়া সৈয়দ রাসেলের কথা ভুল করেও মনে পড়ে না আমাদের।
২০০৭ এর বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক জয়ের কথা বলতে গেলেই মাশরাফির ৪ উইকেট আর তামিমের মারকাটারী ব্যাটিং এর কথাই মনে পড়ে আমাদের। সেই ম্যাচে সৈয়দ রাসেল উইকেট না পেলেও দারুন কিপটে বোলিং করেছিলেন। দশ ওভারে দিয়েছিলেন ৩১ রান,যার সুবাদে ভারত করেছিলো ৩০ ওভারে ৯০ রান।
উইকেট পান বা না পান,নিজেকে প্রমান করেছিলেন কিপটে বোলার হিসেবে। বল ডট দিয়ে ব্যাটসম্যানকে চাপে ফেলে নাচাতে পারতেন দারুনভাবে। আবার বোলিংয়ে এসে প্রথমেই উইকেট নিয়ে মোমেন্টাম টা নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে পারতেন, প্রয়োজনের সময় ব্রেক থ্রু আনতে অধিনায়কের ভরসার নাম ছিলো সৈয়দ রাসেল।
ক্যারিয়ারে বোলিং করেছেন ৪৪১ ওভার,এর মধ্যে ৪১ ওভার ই ছিলো মেডেন।
কিন্তু পেস বোলারদের সবসময়ের শত্রু ইঞ্জুরিটা রাসেলের ক্যারিয়ারে কাল হয়ে দাড়ালো। ইঞ্জুরিটার চেয়েও রাসেলের ক্যারিয়ারে বড় বাধা হয়ে আসে তখনকার টাইগার কোচ জেমি সিডন্সের অবমূল্যায়ন।
সিডন্সের অর্ডিনারি তকমা এবং গতির অযুহাতে জাতীয় দলের ক্যারিয়ার টা লম্বা হয়নি আর। জাতীয় দলে মান সম্মত পেসারের অভাব এর সময় সিডন্সের গতির অযুহাত দিয়ে রাসেলকে বাদ দেওয়াটা বিতর্কের জন্ম দেয় তখন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৬৪ ম্যাচে ৭৭ টি উইকেট নেওয়া এই পেসার দেশের হয়ে সর্বশেষ মাঠে নামেন ২০১০ সালের আয়ারল্যান্ড এর বিপক্ষে। এর পর থেকেই ব্রাত্য হয়ে আছেন। পরবর্তিতে ফিরেছিলেন তবে ইঞ্জুরির প্রিয়জন হয়ে উঠায় ছিটকে পরেন বারবার।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন তাসকিন,মুস্তাফিজের যুগ চলছে। গতি, বাউন্স,কাটার দিয়ে বোকা বানাচ্ছেন বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের। নির্দিষ্ট বোলারের জন্য এখন আলাদাভাবে অনুশীলন করতে হচ্ছে বিপক্ষ দলের।
দেশের হয়ে এইরকম খেলোয়াড়দের খেলায় আমাদের গর্ব হয়,আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি। ইয়র্কারে উপড়ে পড়ে স্টাম্প,ব্যাটসম্যান শুয়ে থাকেন ক্রিজে, এই রকম মধুর দৃশ্য আমরা বারংবার দেখতে চাই।
কিন্তু আমরা যারা এই বাংলাদেশ টিমকে দেখার আগের নখ দন্তহীন বাংলাদেশকে দেখেছি,সেই বাংলাদেশের হয়ে বা হাতি সৈয়দ রাসেল এর সুইংয়ে বিভ্রান্ত হয়ে বিপক্ষ টিমের সেরা ব্যাটসম্যানদের নাচতে থাকার দৃশ্য এখনো চির সবুজ আমাদের কাছে।
মানুষটার আর ফেরা হবে না জাতীয় দলে। ৬ বছরের ছোট ক্যারিয়ারে যা দিয়েছেন তাতেই ক্রীড়া প্রেমীরা মনে রাখবে অনেক দিন। সব সময়ের জন্য ভালোবাসা এই মানুষটার জন্য।