ফিলিস্তিনে চরম উত্তেজনা

- আপডেটের সময় : ১১:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭
- / ১২৭২ টাইম ভিউ
ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমকে স্বীকৃতি দেয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠার পর বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনি নাগরিকরা শুক্রবার ‘বিক্ষোভ দিবসের’ ডাক দিয়েছে। খবর এএফপি’র।
ফিলিস্তিনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার জানান, দীর্ঘদিনের নীতি পরিবর্তন করায় ফিলিস্তিনে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে অভিনন্দন জানানো হয়নি। এর মধ্যদিয়ে বিতর্কিত এ নগরীর বিষয়ে দীর্ঘ কয়েক দশকের অস্পষ্ট মার্কিন নীতির অবসান ঘটলো।
এটা নিয়ে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ মাসের শেষের দিকে পেন্স ও ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত একটি বৈঠক তারা ‘পাল্টা পদক্ষেপ’ হিসেবে বাতিল করবে।
ট্রাম্পের এমন স্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে এমন উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরে আরো কয়েকশ’ সৈন্য মোতায়েন করেছে।
ট্রাম্পের এমন ঘোষণায় বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনেক প্রশংসা করে বলেন, জেরুসালেমের দীর্ঘদিনের ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে। তিনি বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে ট্রাম্পকে অনুসরণ করতে বলেন।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানায়, গাজা সিটিতে এক ভাষণে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া নতুন করে যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে গাজা উপত্যকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গুলির শব্দ শোনা যায়।
গাজা কর্তৃপক্ষ জানায়, ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমকে ট্রাম্প স্বীকৃতি দেয়ার প্রতিবাদে গাজার পাশাপাশি পশ্চিম তীরে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। গাজায় বিক্ষোভ সমাবেশে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে পাঁচ ফিলিস্তিনি নাগরিক আহত হয়েছে।
ফিলিস্তিনি রেডক্রস জানায়, পশ্চিম তীরে বন্দুকের গুলি বা রাবার বুলেটের আগাতে ২২ জন আহত হয়।
এদিকে রামাল্লাহ’র প্রবেশ পথের একটি নিরাপত্তা ফাঁড়িতে সমবেত হওয়া বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ইসরাইলি বাহিনী টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করতে হয়।
গাজায় ইসরাইলের বিমান ও ট্যাংক হামলা
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার দুটি নিরাপত্তা চৌকির ওপর বিমান ও ট্যাংক নিয়ে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
ইসরাইল দাবি করেছে, গাজা থেকে ছোঁড়া রকেটের জবাবে তারা এই হামলা চালিয়েছে।
গাজা থেকে এ ধরনের হামলার জন্য ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসকে দায়ী করেছে ইসরাইল। তবে হামাস এ সম্পর্কে এখনো কোনো বক্তব্য দেয়নি।
বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফিলিস্তিনের বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী বলে স্বীকৃতি দেয়ার পর এই হামলা চালানো হলো। ট্রাম্পের ঘোষণার আগে ও পরে সারা বিশ্ব থেকে সতর্ক করা হয়েছে, এ ধরনের উদ্যোগের ফলে ফিলিস্তিনে ভয়াবহ অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে। তবে সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন। পাশাপাশি তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস বায়তুল মুকাদ্দাসে সরিয়ে নেয়ার কথাও বলেছেন ট্রাম্প।
ফিলিস্তিনে নতুন ইন্তিফাদা ঘোষণা
ইসরাইলের বিরুদ্ধে নতুনভাবে ইন্তিফাদা বা গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণা দিয়েছে ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ বা হামাস নামে পরিচিত স্বাধীনতাকামী সংগঠন। পবিত্র ভূমি জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের স্বীকৃতির পর বৃহস্পতিবার হামাসের প থেকে এ ধরনের ঘোষণা আসে।হামাসের একজন নেতা ইসমাইল হানিয়া গাজায় দেয়া ভাষণে জানান, ইহুদি শত্রুর মোকাবেলার জন্য আমাদের ইন্তিফাদা ঘোষণা করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করা উচিত। সংগঠনটি বলছে, জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প ‘জাহান্নামের দরজা’ খুলেছেন।
জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তিপ্রক্রিয়া’ ধ্বংস করেছে বলে মন্তব্য করেছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠন পিএলও। যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত ট্রাম্পের পদপেকে ‘মরণ কামড়’ আখ্যা দিয়েছে।
ইসমাইল বলেন, ট্রাম্পের ঘোষণায় ইতিহাস ও ভূগোল পাল্টে যাবে না। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব এই সিদ্ধান্ত মানবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
হামাস বলেছে, ট্রাম্প বাইতুল মুকাদ্দাসকে দখলদার ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ফিলিস্তিনি জাতির প্রতি প্রকাশ্য শত্রুতা শুরু করেছেন। ট্রাম্পের এই ঘোষণার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানানোর জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হামাস।
টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ওই ভাষণে তিনি বলেন, ‘জেরুসালেমকে রার নতুন ইন্তিফাদায় অংশ নিতে শুক্রবার ফিলিস্তিনিদের রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এই ইন্তিফাদায় বিজয়ের ব্যাপারে আমাদের আত্মবিশ্বাস রয়েছে। যেকোনো ধরনের হুমকি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকতে হামাসের সব ইউনিটকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতেও মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান হামাস নেতা।
এর আগে দু’টি বড় ধরনের ইন্তিফাদার ডাক দিয়েছিল ফিলিস্তিন। প্রথম ইন্তিফাদা ছিল ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। তখন এটি ছিল মূলত একটি অসহযোগ আন্দোলন এবং গেরিলা প্রতিরোধ। ইসরাইল যেভাবে এই ইন্তিফাদাকে প্রতিহত করেছিল, দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন তিন শব্দে তা ব্যাখ্যা করেছেন। ওই তিন শব্দ হচ্ছে, ‘জবরদস্তি, শক্তি এবং আঘাত’।
প্রথম ইন্তিফাদা চলাকালে শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরাইলি বাহিনী। ইচ্ছা করেই বহু মানুষকে পঙ্গু করে দেয়া হয়। হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হন হাজার হাজার মানুষ।
সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন কয়েক হাজার সেনা নিয়ে জেরুসালেমের পুরনো শহর (ওল্ড সিটি) এবং মাসজিদুল আকসা ভ্রমণ করতে দ্বিতীয় দফায় ইন্তিফাদা শুরু হয়। ২০০০ সালে শুরু হয়ে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকে।
প্রথম ইন্তিফাদার সময় ফিলিস্তিনিরা ব্যবহৃত টায়ার থেকে নেয়া রাবারের চাকতিতে একটি লোহার পেরেক ঢুকিয়ে একধরনের টায়ার ছিদ্রকারী যন্ত্র উদ্ভাবন করে। পশ্চিম তীরে ইসরাইলের দখলকৃত অঞ্চলগুলোর প্রধান সড়কগুলোতে এ যন্ত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়।
ইসরাইলের ধারণা ছিল, ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ-প্রতিরোধ অকার্যকর হয়ে পড়বে। কিন্তু আদতে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ইসরাইলি বাহিনী ও অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা আর হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আরো বেগবান হয়।
মূলত ইন্তিফাদার মাধ্যমেই প্রতিবেশী কোনো আরব দেশের সহায়তা ছাড়া দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হন ফিলিস্তিনিরা। ব্যাপক অত্যাচার-নির্যাতন, নিজেদের ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, হত্যাকাণ্ডের মুখেও ফিলিস্তিনিরা ওই প্রতিরোধ সংগ্রাম থেকে পিছু হটেনি। এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সম হয়। – আলজাজিরা ও মিডলইস্ট আই