ঢাকা , শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আপডেট :
বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনে হত্যার প্রতিবাদে পর্তুগালে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশী প্রবাসীরা প্রিয়জনদের মানসিক রোগ যদি আপনজন বুঝতে না পারেন আওয়ামীলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা ও অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা করেছে পর্তুগাল আওয়ামীলীগ যেকোনো প্রচেষ্টা এককভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়: দুদক সচিব শ্রীমঙ্গলে দুটি চোরাই মোটরসাইকেল সহ মিল্টন কুমার আটক পর্তুগালের অভিবাসন আইনে ব্যাপক পরিবর্তন পর্তুগাল বিএনপি আহবায়ক কমিটির জুমে জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয় এমপি আনোয়ারুল আজিমকে হত্যার ঘটনায় আটক তিনজন , এতে বাংলাদেশী মানুষ জড়িত:স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকাস্থ ইরান দুতাবাসে রাইসির শোক বইয়ে মির্জা ফখরুলের স্বাক্ষর

প্রকৃতির প্রত্যাবর্তন যেন টেকসই হয়

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
  • আপডেটের সময় : ০২:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ জুন ২০২০
  • / ৩৫৮ টাইম ভিউ

বিশ্ব যখন জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়ের অবশ্যম্ভাবী নেতিবাচক ফল নিয়ে মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ঠিক তখনই কোভিড-১৯–এর আগমন। ভয়াবহ এ বিপর্যয় কেবল স্বাস্থ্য খাতে নয়, পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী অন্যান্য খাতের ভিতকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। এসব খাতে নিয়ন্ত্রণ আনার দাবি বারবার উচ্চারিত হলেও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো উন্নয়নের দোহাই দিয়ে তা করেনি।

বিশ্ব যখন জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়ের অবশ্যম্ভাবী নেতিবাচক ফল নিয়ে মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ঠিক তখনই কোভিড-১৯–এর আগমন। ভয়াবহ এ বিপর্যয় কেবল স্বাস্থ্য খাতে নয়, পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী অন্যান্য খাতের ভিতকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। এসব খাতে নিয়ন্ত্রণ আনার দাবি বারবার উচ্চারিত হলেও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো উন্নয়নের দোহাই দিয়ে তা করেনি।

সরকারগুলোর অবস্থান পরিবেশ ও উন্নয়নকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, যা মোটেও বস্তুনিষ্ঠ নয়। যেহেতু পাঁচটি মৌলিক অধিকারের চারটি—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার সরবরাহ আসে প্রকৃতি থেকে; যেহেতু নিশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দেয় প্রকৃতি, সেহেতু প্রকৃতি ধ্বংস করে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আর যা–ই হোক উন্নয়ন হতে পারে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিছু কোম্পানি ও স্বার্থগোষ্ঠীর সঙ্গে জনস্বার্থ এবং জনগণের উন্নয়নের ফারাক বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। এই রাজনৈতিক নেতৃত্বই মূলত ভ্রান্তভাবে পরিবেশ ও উন্নয়নকে বিরোধপূর্ণ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

কোভিড-১৯–এর কারণে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে কমেছে শিল্পদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নিঃসরিত কার্বন। বেড়েছে সবুজের সমারোহ আর প্রাণপ্রকৃতির সাড়া। বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী নগরীগুলোর অন্যতম ঢাকাতেও এখন বিভিন্ন পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে বোধোদয় হতেই জেলা প্রশাসক, সংসদ সদস্য এমনকি মন্ত্রীরাও অতি অবহেলিত কৃষকের ধান কাটাতে উদ্যোগী হয়েছেন। অর্থাৎ, করোনা অর্থনীতির চলমান ধারা থেকে সম্ভাব্য মূল খাতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। লোভ লালসার ও সীমাহীন উন্নয়নের নেশায় প্রকৃতিতে‌ যে আগ্রাসন চলছিল‌, তার সাময়িক বিরতিতে প্রকৃতি তার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। এখন প্রতাপশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না চাইলেও কার্বন নিঃসরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই রেকর্ড ৭ শতাংশ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। ঢাকার বাতাসের মান ভালো হচ্ছে; অন্তত দুই মাস এ নগরীর বাসিন্দারা কর্ণ বিদারণকারী হর্নের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়েছে।

প্রকৃতির এমন ফিরে আসাকে স্বাগত জানালেও প্রশ্ন উঠছে, এ প্রত্যাবর্তন টেকসই হবে কি না। এর যৌক্তিক উত্তর আমাদের এখনই খুঁজতে হবে। এখনই করতে হবে এমন পরিকল্পনা,যাতে আমরা আর বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী নগরীর তালিকার শীর্ষে না থাকি, আমরা যেন সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর হিসেবে পরিচিত না হই, আমাদের বন যেন বাঁচে, বন্য প্রাণী যেন আর সীমাহীন নিষ্ঠুরতার শিকার না হয়।

কোভিড-১৯ পরবর্তী দেশের পরিবেশ প্রশাসন কেমন হওয়া উচিত? আমার বিবেচনায় প্রথম যে উপলব্ধিটি আমাদের আনতে হবে, তা হলো উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা যাবে না। আমরা শত শত শিল্পকারখানা করতে পারব; কিন্তু একটি বন বা একটি নদী সৃষ্টি করতে পারব না। যা আমরা সৃষ্টি করতে পারব না, তা ধ্বংসের কোনো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আইনগত অধিকার আমাদের নেই। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হলো, প্রকৃতি অমূল্য—এর মূল্য টাকার অঙ্কে নির্ধারণ করা যাবে না। তৃতীয়ত, এটা মানতে হবে যে ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, সুন্দরবন সবার। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নদী, বন, কৃষিকে বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না, ক্ষতির মুখোমুখি করা যাবে না।

উপলব্ধি ঠিক করলে কাজ সহজ হয়ে পড়ে, যেমন হয়েছে ভুটানে। আমরা চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন চাই না। কেননা তা ভ্রান্ত এবং তা পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি করেছে। বন উজাড় করছে, ধ্বংস করছে; কৃষিজমি, জলাশয় গ্রাস করেছে; বাতাসে বিষ ঢালছে এমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উন্নয়ন নয়। এসব কারণে আমরা রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প চাই না। আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না। আমরা চাই সাশ্রয়ী সৌরবিদ্যুৎ।

আমরা প্রকৃতিকে হারাব না, প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব না। আমরা প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করব। বেপরোয়া উন্নয়নের লাগাম টানব।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।

পোস্ট শেয়ার করুন

প্রকৃতির প্রত্যাবর্তন যেন টেকসই হয়

আপডেটের সময় : ০২:২৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ১০ জুন ২০২০

বিশ্ব যখন জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়ের অবশ্যম্ভাবী নেতিবাচক ফল নিয়ে মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ঠিক তখনই কোভিড-১৯–এর আগমন। ভয়াবহ এ বিপর্যয় কেবল স্বাস্থ্য খাতে নয়, পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী অন্যান্য খাতের ভিতকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। এসব খাতে নিয়ন্ত্রণ আনার দাবি বারবার উচ্চারিত হলেও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো উন্নয়নের দোহাই দিয়ে তা করেনি।

বিশ্ব যখন জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়ের অবশ্যম্ভাবী নেতিবাচক ফল নিয়ে মহাদুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ঠিক তখনই কোভিড-১৯–এর আগমন। ভয়াবহ এ বিপর্যয় কেবল স্বাস্থ্য খাতে নয়, পরিবেশদূষণের জন্য দায়ী অন্যান্য খাতের ভিতকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। এসব খাতে নিয়ন্ত্রণ আনার দাবি বারবার উচ্চারিত হলেও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো উন্নয়নের দোহাই দিয়ে তা করেনি।

সরকারগুলোর অবস্থান পরিবেশ ও উন্নয়নকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, যা মোটেও বস্তুনিষ্ঠ নয়। যেহেতু পাঁচটি মৌলিক অধিকারের চারটি—খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার সরবরাহ আসে প্রকৃতি থেকে; যেহেতু নিশ্বাসের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দেয় প্রকৃতি, সেহেতু প্রকৃতি ধ্বংস করে পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আর যা–ই হোক উন্নয়ন হতে পারে না। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিছু কোম্পানি ও স্বার্থগোষ্ঠীর সঙ্গে জনস্বার্থ এবং জনগণের উন্নয়নের ফারাক বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। এই রাজনৈতিক নেতৃত্বই মূলত ভ্রান্তভাবে পরিবেশ ও উন্নয়নকে বিরোধপূর্ণ বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছে।

কোভিড-১৯–এর কারণে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে কমেছে শিল্পদূষণ, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নিঃসরিত কার্বন। বেড়েছে সবুজের সমারোহ আর প্রাণপ্রকৃতির সাড়া। বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী নগরীগুলোর অন্যতম ঢাকাতেও এখন বিভিন্ন পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়ে বোধোদয় হতেই জেলা প্রশাসক, সংসদ সদস্য এমনকি মন্ত্রীরাও অতি অবহেলিত কৃষকের ধান কাটাতে উদ্যোগী হয়েছেন। অর্থাৎ, করোনা অর্থনীতির চলমান ধারা থেকে সম্ভাব্য মূল খাতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। লোভ লালসার ও সীমাহীন উন্নয়নের নেশায় প্রকৃতিতে‌ যে আগ্রাসন চলছিল‌, তার সাময়িক বিরতিতে প্রকৃতি তার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে। এখন প্রতাপশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না চাইলেও কার্বন নিঃসরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই রেকর্ড ৭ শতাংশ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। ঢাকার বাতাসের মান ভালো হচ্ছে; অন্তত দুই মাস এ নগরীর বাসিন্দারা কর্ণ বিদারণকারী হর্নের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়েছে।

প্রকৃতির এমন ফিরে আসাকে স্বাগত জানালেও প্রশ্ন উঠছে, এ প্রত্যাবর্তন টেকসই হবে কি না। এর যৌক্তিক উত্তর আমাদের এখনই খুঁজতে হবে। এখনই করতে হবে এমন পরিকল্পনা,যাতে আমরা আর বিশ্বে বসবাসের অনুপযোগী নগরীর তালিকার শীর্ষে না থাকি, আমরা যেন সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শহর হিসেবে পরিচিত না হই, আমাদের বন যেন বাঁচে, বন্য প্রাণী যেন আর সীমাহীন নিষ্ঠুরতার শিকার না হয়।

কোভিড-১৯ পরবর্তী দেশের পরিবেশ প্রশাসন কেমন হওয়া উচিত? আমার বিবেচনায় প্রথম যে উপলব্ধিটি আমাদের আনতে হবে, তা হলো উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা যাবে না। আমরা শত শত শিল্পকারখানা করতে পারব; কিন্তু একটি বন বা একটি নদী সৃষ্টি করতে পারব না। যা আমরা সৃষ্টি করতে পারব না, তা ধ্বংসের কোনো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আইনগত অধিকার আমাদের নেই। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হলো, প্রকৃতি অমূল্য—এর মূল্য টাকার অঙ্কে নির্ধারণ করা যাবে না। তৃতীয়ত, এটা মানতে হবে যে ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, সুন্দরবন সবার। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে নদী, বন, কৃষিকে বন্দোবস্ত দেওয়া যাবে না, ক্ষতির মুখোমুখি করা যাবে না।

উপলব্ধি ঠিক করলে কাজ সহজ হয়ে পড়ে, যেমন হয়েছে ভুটানে। আমরা চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন চাই না। কেননা তা ভ্রান্ত এবং তা পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি করেছে। বন উজাড় করছে, ধ্বংস করছে; কৃষিজমি, জলাশয় গ্রাস করেছে; বাতাসে বিষ ঢালছে এমন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উন্নয়ন নয়। এসব কারণে আমরা রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প চাই না। আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চাই না। আমরা চাই সাশ্রয়ী সৌরবিদ্যুৎ।

আমরা প্রকৃতিকে হারাব না, প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব না। আমরা প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করব। বেপরোয়া উন্নয়নের লাগাম টানব।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান: প্রধান নির্বাহী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)।