আপডেট

x


কুলাউড়ার ঐতিহ্য ডাক বাংলা ; আর ডাক বাংলার ঐতিহ্য লিটন ভাই

বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট ২০২০ | ৮:৩২ অপরাহ্ণ | 628 বার

কুলাউড়ার ঐতিহ্য ডাক বাংলা ; আর ডাক বাংলার ঐতিহ্য লিটন ভাই

কুলাউড়ার ঐতিহ্য ডাক বাংলা ; আর ডাক বাংলার ঐতিহ্য লিটন ভাই এবং তার পরিবার — আহসানুজ্জামান রাসেল

একসময় কুলাউড়ার সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ক্রীড়াঙ্গনের সূতিকাগার বা কেন্দ্রবিন্দু বলা হতো ডাক বাংলা মাঠকে। এই মাঠকে বাদ দিয়ে কুলাউড়ার ফুটবলের ইতিহাস লেখা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই ডাক বাংলার বর্তমান বেহাল অবস্থা (ছবি সংযুক্ত) সাবেক অনেক তারকা ফুটবলার সহ সচেতন মহলের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। ব্যাডমিন্টন, ভলিবল, ফুটবল, ক্রিকেট, দাবা সহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসের আয়োজন (বিশেষ করে বিজয় মেলা) উদিচি, জাতীয় তরুন সংঘ, লাল সূর্য খেলাঘর আসর এবং শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে একসময় মুখরিত থাকতো এই ডাক বাংলা মাঠ। বিভিন্ন প্রজন্মের কাছে অনেকটা মান্না দের “কফি হাউসের” মতো ছিলো এই ডাক বাংলা। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই ডাক বাংলা মাঠের দক্ষিণ পাশে টিনশেডের একটা ঘরে নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করা হয় এবং সেই বিদ্যালয় হারিকেন জ্বালিয়ে পরিচালনা করতেন কাদিপুরের সাবেক শিক্ষক প্রয়াত মখলিছ স্যার। বাঁশের বেড়ায় ঘেরা এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন মূলত শ্রমজীবী মানুষেরা। পরবর্তীতে এখানে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্টা করা হয় এবং এই লাইব্রেরি খুব জমজমাট ছিলো। খেলাধুলা সহ অনেক নীতিনির্ধারণী বৈঠক হতো এই লাইব্রেরিতে। পাশের রুমগুলো ছিলো ক্রীড়া সংস্থা এবং শিল্পকলা একাডেমির অফিস। ডাক বাংলা সম্পর্কে এসব তথ্য আমি যার কাছ থেকে পেয়েছি তিনি এই ডাকবাংলারই বাসিন্দা এককালের কৃতি ফুটবলার যাকে সবাই ডাক বাংলার লিটন নামেই চিনে।



লিটন ভাইর পুরো নাম জামাল উদ্দিন আহমেদ। উনার বাবা প্রয়াত আজিম উদ্দিন আহমদ যিনি ডিআইবি দারোগা নামে পরিচিত ছিলেন। তিন বোন এবং পাঁচ ভাইর মধ্যে লিটন ভাই চতুর্থ। উনার ছোট ভাই Md Rahman কামাল কুলাউড়ার ক্রীড়াঙ্গনের আরেকটি সুপরিচিত নাম। লিটন ভাইর খেলাধুলার হাতেখড়ি এই ডাক বাংলা মাঠ থেকে। আসলে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় লিটন ভাইদের পুরো ব্যাচ কাবুল, তারহাম, মান্না, আকবর, মামুন, নাসির সহ আরো অনেকেই দিন রাত এই ডাকবাংলা মাঠে পড়ে থাকতেন এজন্য উনাদের প্রজন্মকে “ডাকবাংলা প্রজন্ম” বলা হতো। আর উনাদের সিনিয়রদের মধ্যে খলিল, মাকু, নিজাম, কেফায়েত, মন্টু, ফয়সাল, বাদল, মতিনরা এনসি স্কুল মাঠে ফুটবল খেলতেন। সত্যি কথা বলতে একজন ফুটবলার হিসেবে লিটন ভাই হয়তো খলিলুর রহমানের মতো নক্ষত্র ছিলেন না, গিয়াস উদ্দিন মান্নার মতো কুলাউড়ার যুবরাজ ছিলেন না, আবুল খায়ের ফয়সালের মতো বাজ পাখি খেতাব ছিলো না, মতিউর রহমান মতিন এবং বাদল দাশের মতো ফুটবল ভলিবল ব্যাডমিন্টনের ত্রিমুখী প্রতিভা ছিলো না, নিজামুল ইসলামের মতো ফুটবলের বরপুত্র ছিলেন না, আব্দুল হাই মন্টু কিংবা কেফায়েত খাঁনের মতো অলরাউন্ডারের পাশাপাশি দর্শকপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ছিলেন না, এমাদুল মান্নান তারহামের মতো সুপার আইডল এমনকি কাবুল পালের মতো ক্যারিশমাটিক নৈপূন্য ছিলো না। তবে লিটন ভাই ছিলেন ফুটবলের একজন “অনুগত এবং বাধ্য ছাত্র” যিনি ফুটবলকে মন প্রান দিয়ে ভালোবাসতেন, সবার আগে প্র্যাকটিসে যেতেন এবং সবার পরে প্র্যাকটিস থেকে ফিরতেন, সিনিয়রদের সবসময় সম্মান করতেন, জুনিয়রদের ভালোবাসতেন। মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হলেও অত্যন্ত সুযোগ সন্ধানী ছিলেন বলে প্রতিপক্ষ গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে বল জালে পাঠাতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। লিটন ভাইর বাল্যবন্ধু Kabul পালের মুখে শুনুন ” লিটন আমার বাল্যবন্ধু তার সবচেয়ে বড় গুন সকাল বিকাল প্র্যাকটিসে কোন ফাঁকি দিতোনা এবং খুব পরিশ্রম করে খেলতো। খেলার মাঠে কোন দিন কারও সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি, কোন অহংকার ছিল না, অত্যন্ত ভদ্র ও নম্র খেলোয়াড় ছিলো। কোন খেলোয়াড় বিপদে পরলে যেকোন ভাবে হোক তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। লিটনের বাসা ছিলো আমার ঠিকানা, খাওয়া-দাওয়া ঘুমানো সবই ছিলো ওদের বাসায়। আমি কোন দিন খেলার জন্য কুলাউড়ার বাহিরে গেলে,আমার বাবা লিটনের বাসায় খোঁজতো এবং দেরি হলে বাবা কান্নাকাটি করতো। তখন লিটনের বড় বোন রেবা আপা বাবাকে চা নাস্তা খাইয়ে স্বান্তনা দিতেন। এককথায় লিটনের পরিবারের সবাইও ভালো মনের মানুষ ছিলেন।” এখনকার প্রজন্ম শুনলে হয়তো অবাকই হবে প্রতিদিন ভোর চারটায় কাবুল পাল এবং মাঝে মধ্যে বন্ধু বজলুকে সাথে নিয়ে ডাকবাংলা থেকে ব্রাম্মনবাজার পর্যন্ত লিটন ভাই মর্নিং ওয়ার্ক করতেন শরীরের ফিটনেস ধরে রাখার জন্য।

লিটন ভাইর সাথে আলাপকালে কুলাউড়ার ফুটবলের সাথে জড়িত ছিলেন এরকম কিছু মানুষের নাম উঠে এসেছে যাদের কথা বর্তমান প্রজন্ম জানার দরকার বলে আমি মনেকরি। ডাকবাংলা প্রজন্মের যে ফুটবল টিম ছিলো সে টীমকে অনুশীলন করাতেন লিটন ভাইর মামা সফিকুর রহমান নুনু। পরবর্তীতে এনসি স্কুলে টীমে লিটন ভাইদের খেলার গুরু ছিলেন সর্বদা সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরিহিত প্রয়াত বারী স্যার যিনি খেলায় কখনো হারতে চাইতেন না। লিটন ভাই আরো স্মরণ করেন Abul Fattah ফজলু স্যারের কথা যিনি ডাক বাংলা এবং এনসি স্কুল মাঠে মাটি ভরাটের দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং লিটন ভাইদের অনুরোধে প্রায় সময় ২/৩ ট্রাক মাটি বেশী দিতেন। এছাড়াও যাদের সাথে বিভিন্ন সময় উনি খেলেছেন তাদের অনেকের নাম আগে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে রাবেয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক Abdus Salam, চলন্তিকা টিমের উনাদের গুরু কুতুব ভাই, মৌলভীবাজারের আহবাব ভাই যিনি কুতুব ভাইর বোন জামাই, গোলকিপার শহীদুল্লাহ যিনি পুলিশ টিমে খেলতেন, ব্রাম্মনবাজারের মখলিছ, বাছিদ, বজলু, Suruk, তারেক, তমাল, সাংবাদিক মছব্বীর আলীর ভাই প্রয়াত মহরম আলী, জয়পাশার প্রয়াত শাহীন ভাই যিনি খাদিম ভাই নামে পরিচিত এবং এই খাদিম ভাই মাঠে এসে সবার আগে খবর নিতেন উনি একাদশে আছেন কিনা।

লিটন ভাইর স্মরনীয় খেলার মধ্যে আছে বনিক সমিতির সাথে চলন্তুিকার ফাইনাল ম্যাচ, যে ম্যাচে চলন্তিকাকে আর্থিক সহযোগীতা করেছিলো জাতীয় তরুণ সংঘ। কুতুব ভাইর নেতৃত্বে এই ম্যাচে চলন্তিকার হয়ে খেলেছিলেন ঢাকা চলন্তিকার পিটার্স সহ আরো কয়েকজন যদিও এই ম্যাচে টাইব্রেকারে চলন্তিকা হেরে যায়। আর করিমপুর চা বাগান মাঠে ডানকানের বাগানদের নিয়ে একটা টুর্নামেন্ট হয়েছিলো যেখানে লিটন ভাই খেলেছিলেন শাহীন ভাইর টীম লংলা চা বাগানের হয়ে। এই টুর্নামেন্টে লংলা চা বাগান চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো। আলাপচারিতায় লিটন ভাই নিজেকে কখনো ভালো প্লেয়ার বলে দাবি করেননি এবং কুলাউড়ার বাইরে মৌলভীবাজার কিংবা সিলেটে খেলেছেন বলেও দাবি করেননি। তবে কুলাউড়া এবং আশে পাশের থানার বিভিন্ন মাঠে তাঁদের প্রজন্মের অন্যদের নিয়ে একটা টীম হিসেবে দাপটের সহিত ফুটবল খেলেছেন।

লিটন ভাই কুলাউড়ার ঐতিহ্যবাহী সংগঠন জাতীয় তরুণ সংঘের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন দুইবার। দুই কন্যা সন্তানের জনক এই মহান মানুষটি বর্তমানে সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। একজন ভালো খেলোয়াড় এবং ভালো সংগঠকের পাশাপাশি লিটন ভাই যে সমাজের একজন সেবক তা আমার বন্ধু কাদিপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মুকিম চাচার মেয়ে বড়লেখার সুজাউল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক Sabrin Sultana ইমার মন্তব্য থেকে বুঝা যায়। লিটন ভাই সম্পর্কে ইমার মন্তব্য হুবহু এরকম ” চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন যেখানেই যাও হৃদয়টাকে সাথে নিয়ে যাও। লিটন চাচা এমনই একজন মানুষ যিনি মানুষের অন্তরের আকুতি বুঝতে পারেন। তার সম্পর্কে লেখতে গেলে অল্প কথায় শেষ করা যাবেনা। আমার সাথে পরিচয় ফেইসবুকে, কোনদিন আমাকে দেখেননি। শুধুমাত্র বাড়ী কুলাউড়া আর বাবার পরিচয় এইটুকু নিয়েই উনি আমার স্কুলের ছাত্রীর অপারেশন করিয়ে মানবতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা আমি কখনো ভুলবো না। আমাকে আরো উৎসাহ দিয়েছেন এরকম মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে আরো লেখার জন্য। এই উদার মনের মানুষটির শারীরিক সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করছি।”

 

মন্তব্য করতে পারেন...

comments


deshdiganto.com © 2019 কপিরাইট এর সকল স্বত্ব সংরক্ষিত

design and development by : http://webnewsdesign.com