ঢাকা , শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
আপডেট :
কুলাউড়া বিএনপির দীর্ঘ যুগ পর কোন্দলের অবসান। ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার অঙ্গীকার আবু জাহেলদের ব্যার্থ গুপ্ত হত্যা পরিকল্পনার মধ্যে দিয়েই যেভাবে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরত জীবনের শুরু হয় তারেক রহমানের উপস্থাপিত ৩১ দফা’র লিফলেট বিতরন করলো পর্তুগাল সেচ্চাসেবক দল ইতালির তরিনোতে জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ব্রাম্মণবাড়ীয়া জেলা সমিতির অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিয়ে ঝুঁকি তৈরি হলে আমরা সারা দুনিয়া জ্বালিয়ে দেব,মিলানের সেমিনারে বললেন পিনাকী ভট্রাচার্য পর্তুগাল জাসাস’র নবগঠিত কমিটির পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতেবিভিন্ন চক্রান্তে লিপ্ত আ’লীগ গ্রিন সিলেট ট্রাভেলসের আয়োজনে বাংলাদেশে পর্তুগাল দূতাবাস/কনসুলেট চেয়ে খোলা চিঠি স্বৈরাচার সরকার পতনের পর যুক্তরাজ্যে ফিরছেন সিলেট আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি পর্তুগাল শাখার উদ্যোগে বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত! বন্যার্ত মানুষের ত্রান তহবিলের জন্যে ৬ লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা ঘোষণা

করোনা কি আমাদের কদর্য চেহারা দেখিয়ে দিলো? শাহারুল কিবরিয়া ইমন

নিউজ ডেস্ক
  • আপডেটের সময় : ০৫:২২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ মে ২০২০
  • / ৫৩৪ টাইম ভিউ

মার্চ আমাদের দেশে প্রথম করোনা ধরা পড়লো। এর আগে থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট প্রতিনিয়ত জানিয়ে যাচ্ছিলো কিভাবে আমাদের নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থাগুলো করতে হবে।করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়ার পর কিছুটা দেরিতে হলেও সরকার যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছে তা কার্যকর হওয়ার কথা ছিলো। হতে দেইনি আমরা।

কোভিড-১৯ আমাদের রাষ্ট্রের কতখানি ক্ষতি করবে সেটা হয়ত আগামী মাস দেড়েকের মাঝে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। অনেক আক্রান্ত হবে, হয়ত অনেক মানুষ মারা যাবে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার আমরা হবো। দেশে দুর্ভিক্ষ আসতে পারে নাও পারে।আমরা হয়ত কালের বিবর্তনে এসব কাটিয়েও উঠব।

অন্য যে ক্ষতি আমাদের হয়ে গেছে এরই মাঝে সেটার হয়ত কোন ক্ষতিপূরণ আর হবে না। নিজেদের প্রগতিশীল আর মানবিক দাবি করা আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে যে কি অমানবিক কদর্য হিংস্রতা আছে সেটা এরই মাঝে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। সব ক্ষতি কাটিয়ে উঠলেও মানবতার মৃত্যুর ক্ষতি কি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব আর? পুরো বিশ্ব করোনায় কাঁপছে কিন্তু কোথাও কি আমাদের মত অমানবিক আচরণ দেখেছি আমরা?

প্রথমত, ত্রাণ বা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ চুরি করা আমাদের ঐতিহাসিক অভ্যাস।সাধারণ অবস্থায় আমরা এসব মেনেও নেই।এমপি, চেয়ারম্যান মেম্বার হতে গিয়ে ভোটে কত ধরনের খরচ হয়! সাঙ্গপাঙ্গ পোষতে কত খরচা হয়! আমরাও তাই কাবিখা, টিআর এসবের দূর্ণীতিকে আমাদের সহজাত সামাজিকতা বলে মেনে নেই।তাই বলে এখনও? করোনা দেশে দেশে মৃত্যুর বারতা নিয়ে এসেছে। প্রিন্স চার্লস, বরিস জনসন এদের মত লোক পার পায়নি এর থাবা থেকে।তাহলে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কিসের আশায় চুরি করছেন? করোনা তাদের রেহাই দিবে অথবা তাদের উত্তরাধিকারীদের, এমন নিশ্চয়তা কোথায় পান তারা? না কী মরণের ভয় নেই তাদের?

নগদে যা পাও হাত পেতে নাও,

বাকির খাতায় শূন্য থাক?

পরপারের হিসাবের খাতায়ও যে বিরাট শূন্য নিয়ে যাবেন সেই ভয় নেই কেনো? কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে। ধর্ম চলে গেছে মসজিদে মন্দিরে। মানুষের আচারে আচরণে আর জীবনযাপনে ধর্ম শুধুই অলংকারিক।

এতো গেলো সরকারি ত্রাণের কথা। সাধারণ ছুটি ঘোষণার তিনদিনের মাথায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আর ব্যক্তি পর্যায়ে ত্রাণ বিতরনের উৎসব শুরু হলো। যে কারণে সাধারণ ছুটি, সেই সামাজিক দূরত্ব রক্ষার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেনতেনভাবে যত্রতত্র শুরু হলো ত্রাণ বিতরণ। কোন সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক গ্লাভস কিছুর বালাই নেই।মাত্র তিনদিন বন্ধ থাকায় দেশে এত অনাহারী দেখা দিলো, মাত্র তিনদিনের মাথায় সবার ঘরের খাবার ফুড়িয়ে গেলো!

এই ত্রাণ কার্যক্রম যে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুনোর একটা উছিলা ছিলো সেটা বুঝে সরকার বাহাদুর কঠোর হলে এটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের মৃত্যুর সাথে মানবতারও মৃত্যু হয়েছে। দেশে দেশে বেলকনিতে দাড়িয়ে হাততালি দিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে আর ঘরের লাইট নিভিয়ে মানুষ ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী আর সম্মুখ সমরের সকল যোদ্ধাদের সম্মান জানাচ্ছে।আমরা কেনো পিছিয়ে থাকব? আমরা ভাড়াটিয়া ডাক্তারকে বাসা থেকে তাড়িয়ে, করোনা পজিটিভ আসা ডাক্তারের বাসায় আক্রমণ করে আর রোগাক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীকে পুকুরপাড়ে ফেলে রেখে সম্মান জানাচ্ছি।

নারায়ণগঞ্জে এক ডাক্তারের পুরো পরিবারের ১৭ জন সদস্যের করোনা পজিটিভ এসেছে। সম্মান জানাতে সচেতন নাগরিকগণ ওই মহিলা ডাক্তারের বাসায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছে।পুরো পরিবারকে এলাকাছাড়া করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বারবার ফোন করা হয়েছে।রোগী নিতে আসা এম্বুলেন্স আটকে মানবতার জানাযা পড়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এযাত্রা পরিবারটিকে রক্ষা করলেও কতকাল করতে পারবে কে জানে?

আমরা যদি দেখতাম ওই এলাকার সবাই পরিবারটির সকল দায়িত্ব নিয়েছে? ঐ এলাকার মুরব্বিগণ তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন কিছুর যাতে অভাব না হয় তার ব্যবস্থা নিয়েছেন? যদি দেখতে পেতাম যে এম্বুলেন্স লাগেনি, এলাকার স্বেচ্ছাসেবকরাই রোগী কে পৌঁছে দিয়েছে হাসপাতালে? সব সুরক্ষা নিয়েই। আহা!! এমন যদি হত?!

আমরা যে ডাক্তারের সাথে এমন করছি তিনি কিভাবে করোনায় আক্রান্ত হলেন? আমাদের কাউকে না কাউকে চিকিৎসা দিতে গিয়েই তো? তাহলে তিনি যে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিলেন তার জন্য তাঁকে আমাদের কি ধন্যবাদ দেয়া উচিত ছিলো না? ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী বা অন্য জরুরি সেবা কর্মীদের সাথে আমরা যে আচরণ করছি তাতে তারা যদি সম্মিলিতভাবে আমাদের চিকিৎসা আর সেবা দিতে অস্বীকার করেন? কোথায় যাবো আমি আপনি?

করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞ্যান কতখানি আর অজ্ঞতা কতটুকু আমি জানিনা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমরা করোনাকে এইচআইভি ভাইরাসের সাথে তুলনা করছি।অথবা কুষ্ঠ রোগের সাথে, আদিমকালের মানুষের মত।করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি আমাদের ব্যবহারের কোন যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাইনা। এর সাথে তো ব্যক্তির চরিত্রের কোনো সম্পর্ক নেই! যে কারও কোভিড-১৯ পজিটিভ আসতেই পারে।আমার আপনার।তাই বলে তাদের কেনো সামাজিকভাবে হেয় করা হবে? যারা এসব করছেন, কি ভাবছেন আপনাদের এই রোগ হবে না? তখন আপনার সাথে যখন একই ব্যবহার করা হবে কেমন লাগবে আপনার?

শ্রীমঙ্গল শহরে আমার এক কলিগের কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়েছে।চাকরিতে বেশি দিন হয়নি ওর।এক মাস আগে সে সর্বশেষ ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল এসেছে।তার একমাস পরে যখন শ্রীমঙ্গলের প্রথম রোগী হিসাবে তার করোনা ভাইরাস ধরা পড়লো, শুরু হলো তার জীবনকে বিষিয়ে দেয়ার সমস্ত আয়োজন। ফেসবুকের অপব্যবহার কারা বেশি করে এধরণের জরিপ হলে আমরা নিঃসন্দেহে প্রথম হবো। ফেসবুকের পাতায় পাতায় তার সমালোচনা। কেন সে শ্রীমঙ্গলের মত পবিত্র যায়গায় করোনা নিয়ে আসলো। ভাব এমন যে করোনা এসে পবিত্রতা নষ্ট করে দিলো, আর তার দায়ভার আমার কলিগের।শহরের চৌমুহনীতে নিয়ে বিচারের দাবি তুললেন অনেকে। যেন সে ব্যক্তিগত কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। একটা শহর পবিত্র কিনা তা নির্ভর করে তার বাসিন্দারা কত পবিত্র তার উপর। শ্রীমঙ্গল শহরের এই বাসিন্দারা কি নিজেদের আর পবিত্র ভাবতে পারবেন?

আকিজ গ্রুপের হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ ভন্ডুল করে দিলেন এলাকাবাসী। সিলেটের এক এলাকার বাসিন্দারা সিভিল সার্জন বরাবর স্মারকলিপি দিলেন মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগী ভর্তি না করার দাবীতে। আচ্ছা, এখন শহীদ ডাঃ শামসুদ্দিন হাসপাতালের এলাকার লোকজন যদি একই দাবি তুলে? স্মারকলিপি দেয়া এলাকার কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হন, আপনি চিকিৎসা কোথায় পাবেন? নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করার এই আয়োজন কেনো?

এটা কি এক এলাকার সমস্যা? সর্বত্র এই একই অবস্থা।

কোভিড-১৯ থেকে বাঁচার উপায় একটাই। ঘরে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। অপ্রয়োজনীয় বাইরে ঘুরাফেরা বন্ধ রাখা। আক্রান্ত হলে নিজেকে আইসোলেটেড রাখা। এইতো? তাহলে এই হামলা মারামারি আসছে কেন?

আমরা অতি সচেতন জাতি। সচেতন ভাবে সচেতনতার সব উদ্যোগ আমরা ভেস্তে দিচ্ছি। আমরা ঘরে থাকছি না।সামাজিক দূরত্ব মানছি না। লকডাউন করা রাস্তায় ইফতারের বাজার বসাচ্ছি, দোকানের শাটার ফেলে রেখে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করছি, আক্রান্ত হলে ডাক্তারের কাছে লুকিয়ে রাখছি।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স) বলেছেন মহামারি হলে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করতে। আমরা তার বিপরীতে।নারায়ণগঞ্জ আর ঢাকা থেকে ভাইরাসকে দেশের সর্বত্র পৌছে দেয়ার মহান দায়িত্ব আমরা যত্নের সাথে পালন করছি। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স) বিরূপ পরিস্থিতিতে নিজ ঘরে নামাজ আদায় করতে বলেছেন।আমাদের আলেমগণ, সরকার সবাই বারবার আবেদন জানিয়েও এটা করা যাচ্ছে না। আমাদের সিজনাল নামাজীরা মসজিদের ইজ্জত রক্ষায় সোচ্চার। মসজিদের সৌন্দর্য এর নামাজী। সংখ্যায় নয়, গুনগত মানের নামাজী। আমরা সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাসী। মক্কার কাবাঘর শূন্য রেখে আমরা পাড়ার মসজিদ পূর্ণ করার ঈমানী শক্তি দেখাতে তৎপর। মসজিদে নামাজ পড়তে না পারলে এলাকার ঘরে ঘরে ১৫-২০ জন মিলে জামাত করছেন। অথচ জুম্মা ছাড়া বাকি দিনগুলোতে আমাদের মসজিদগুলো জনশূন্য থাকে।আফসোস।

করোনা যখন বাংলাদেশে আসেনি সেই সময় একদিন একজনের সাথে এ নিয়ে কথা হচ্ছিলো। উনি যুক্তি দেখালেন করোনা আমাদের দেশে কিছু করতে পারবে না। কারণ আমাদের দেশ উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের, আর দ্বিতীয়ত আমাদের দেশের মানুষের ঈমানি শক্তি অনেক বেশি তাই। উনাকে বলেছিলাম প্রায় শতভাগ চোর বাটপার দূর্ণীতিবাজের দেশে ঈমানি শক্তি কিভাবে বাঁচাবে? করোনা হানা দিয়ে দেখিয়ে দিলো কেবল চুরি বাটপারি নয়, মানবিক দিক দিয়েও আমরা কত নিচু স্তরের। মায়ের করোনা হয়ে থাকতে পারে এই আশংকায় তাঁকে জংগলে ফেলে যায় সন্তানেরা, মারা যাওয়া করোনা রোগী দাফনের জায়গা পায়না, মসজিদের খাটিয়া পায়না, আমলদার ইমাম জানাযা পড়ান না, সন্তান অভিভাবকের মৃতদেহ ফেলে রাখে, সন্তানের মৃতদেহ বাসার গেটে ফেলে রাখেন অভিভাবক। আমরা বড়াই করি ঈমানি শক্তির!

ঈমান কেবল মসজিদে নামাজ পড়লেই শক্ত হয় না। কেবল নামাজ পড়েই মুসলমান হওয়া যায় না। ধর্ম কেবল মন্দিরের চারদেয়ালে থেমে থাকেনা। জীবনযাপনে যদি ধর্মকে ধারণ না করতে পারলেন, মনের পশু মারতে না পারলেন, তবে আর নামাজ পড়ার কষ্ট কেনো?

পোস্ট শেয়ার করুন

করোনা কি আমাদের কদর্য চেহারা দেখিয়ে দিলো? শাহারুল কিবরিয়া ইমন

আপডেটের সময় : ০৫:২২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ মে ২০২০

মার্চ আমাদের দেশে প্রথম করোনা ধরা পড়লো। এর আগে থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট প্রতিনিয়ত জানিয়ে যাচ্ছিলো কিভাবে আমাদের নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থাগুলো করতে হবে।করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়ার পর কিছুটা দেরিতে হলেও সরকার যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছে তা কার্যকর হওয়ার কথা ছিলো। হতে দেইনি আমরা।

কোভিড-১৯ আমাদের রাষ্ট্রের কতখানি ক্ষতি করবে সেটা হয়ত আগামী মাস দেড়েকের মাঝে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। অনেক আক্রান্ত হবে, হয়ত অনেক মানুষ মারা যাবে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার আমরা হবো। দেশে দুর্ভিক্ষ আসতে পারে নাও পারে।আমরা হয়ত কালের বিবর্তনে এসব কাটিয়েও উঠব।

অন্য যে ক্ষতি আমাদের হয়ে গেছে এরই মাঝে সেটার হয়ত কোন ক্ষতিপূরণ আর হবে না। নিজেদের প্রগতিশীল আর মানবিক দাবি করা আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে যে কি অমানবিক কদর্য হিংস্রতা আছে সেটা এরই মাঝে প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। সব ক্ষতি কাটিয়ে উঠলেও মানবতার মৃত্যুর ক্ষতি কি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব আর? পুরো বিশ্ব করোনায় কাঁপছে কিন্তু কোথাও কি আমাদের মত অমানবিক আচরণ দেখেছি আমরা?

প্রথমত, ত্রাণ বা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ চুরি করা আমাদের ঐতিহাসিক অভ্যাস।সাধারণ অবস্থায় আমরা এসব মেনেও নেই।এমপি, চেয়ারম্যান মেম্বার হতে গিয়ে ভোটে কত ধরনের খরচ হয়! সাঙ্গপাঙ্গ পোষতে কত খরচা হয়! আমরাও তাই কাবিখা, টিআর এসবের দূর্ণীতিকে আমাদের সহজাত সামাজিকতা বলে মেনে নেই।তাই বলে এখনও? করোনা দেশে দেশে মৃত্যুর বারতা নিয়ে এসেছে। প্রিন্স চার্লস, বরিস জনসন এদের মত লোক পার পায়নি এর থাবা থেকে।তাহলে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কিসের আশায় চুরি করছেন? করোনা তাদের রেহাই দিবে অথবা তাদের উত্তরাধিকারীদের, এমন নিশ্চয়তা কোথায় পান তারা? না কী মরণের ভয় নেই তাদের?

নগদে যা পাও হাত পেতে নাও,

বাকির খাতায় শূন্য থাক?

পরপারের হিসাবের খাতায়ও যে বিরাট শূন্য নিয়ে যাবেন সেই ভয় নেই কেনো? কারণ ধর্মীয় বিশ্বাসের মৃত্যু হয়েছে। ধর্ম চলে গেছে মসজিদে মন্দিরে। মানুষের আচারে আচরণে আর জীবনযাপনে ধর্ম শুধুই অলংকারিক।

এতো গেলো সরকারি ত্রাণের কথা। সাধারণ ছুটি ঘোষণার তিনদিনের মাথায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আর ব্যক্তি পর্যায়ে ত্রাণ বিতরনের উৎসব শুরু হলো। যে কারণে সাধারণ ছুটি, সেই সামাজিক দূরত্ব রক্ষার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেনতেনভাবে যত্রতত্র শুরু হলো ত্রাণ বিতরণ। কোন সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক গ্লাভস কিছুর বালাই নেই।মাত্র তিনদিন বন্ধ থাকায় দেশে এত অনাহারী দেখা দিলো, মাত্র তিনদিনের মাথায় সবার ঘরের খাবার ফুড়িয়ে গেলো!

এই ত্রাণ কার্যক্রম যে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরুনোর একটা উছিলা ছিলো সেটা বুঝে সরকার বাহাদুর কঠোর হলে এটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের মৃত্যুর সাথে মানবতারও মৃত্যু হয়েছে। দেশে দেশে বেলকনিতে দাড়িয়ে হাততালি দিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে আর ঘরের লাইট নিভিয়ে মানুষ ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী আর সম্মুখ সমরের সকল যোদ্ধাদের সম্মান জানাচ্ছে।আমরা কেনো পিছিয়ে থাকব? আমরা ভাড়াটিয়া ডাক্তারকে বাসা থেকে তাড়িয়ে, করোনা পজিটিভ আসা ডাক্তারের বাসায় আক্রমণ করে আর রোগাক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীকে পুকুরপাড়ে ফেলে রেখে সম্মান জানাচ্ছি।

নারায়ণগঞ্জে এক ডাক্তারের পুরো পরিবারের ১৭ জন সদস্যের করোনা পজিটিভ এসেছে। সম্মান জানাতে সচেতন নাগরিকগণ ওই মহিলা ডাক্তারের বাসায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছে।পুরো পরিবারকে এলাকাছাড়া করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বারবার ফোন করা হয়েছে।রোগী নিতে আসা এম্বুলেন্স আটকে মানবতার জানাযা পড়া হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এযাত্রা পরিবারটিকে রক্ষা করলেও কতকাল করতে পারবে কে জানে?

আমরা যদি দেখতাম ওই এলাকার সবাই পরিবারটির সকল দায়িত্ব নিয়েছে? ঐ এলাকার মুরব্বিগণ তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় কোন কিছুর যাতে অভাব না হয় তার ব্যবস্থা নিয়েছেন? যদি দেখতে পেতাম যে এম্বুলেন্স লাগেনি, এলাকার স্বেচ্ছাসেবকরাই রোগী কে পৌঁছে দিয়েছে হাসপাতালে? সব সুরক্ষা নিয়েই। আহা!! এমন যদি হত?!

আমরা যে ডাক্তারের সাথে এমন করছি তিনি কিভাবে করোনায় আক্রান্ত হলেন? আমাদের কাউকে না কাউকে চিকিৎসা দিতে গিয়েই তো? তাহলে তিনি যে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিলেন তার জন্য তাঁকে আমাদের কি ধন্যবাদ দেয়া উচিত ছিলো না? ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী বা অন্য জরুরি সেবা কর্মীদের সাথে আমরা যে আচরণ করছি তাতে তারা যদি সম্মিলিতভাবে আমাদের চিকিৎসা আর সেবা দিতে অস্বীকার করেন? কোথায় যাবো আমি আপনি?

করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞ্যান কতখানি আর অজ্ঞতা কতটুকু আমি জানিনা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমরা করোনাকে এইচআইভি ভাইরাসের সাথে তুলনা করছি।অথবা কুষ্ঠ রোগের সাথে, আদিমকালের মানুষের মত।করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি আমাদের ব্যবহারের কোন যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাইনা। এর সাথে তো ব্যক্তির চরিত্রের কোনো সম্পর্ক নেই! যে কারও কোভিড-১৯ পজিটিভ আসতেই পারে।আমার আপনার।তাই বলে তাদের কেনো সামাজিকভাবে হেয় করা হবে? যারা এসব করছেন, কি ভাবছেন আপনাদের এই রোগ হবে না? তখন আপনার সাথে যখন একই ব্যবহার করা হবে কেমন লাগবে আপনার?

শ্রীমঙ্গল শহরে আমার এক কলিগের কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়েছে।চাকরিতে বেশি দিন হয়নি ওর।এক মাস আগে সে সর্বশেষ ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল এসেছে।তার একমাস পরে যখন শ্রীমঙ্গলের প্রথম রোগী হিসাবে তার করোনা ভাইরাস ধরা পড়লো, শুরু হলো তার জীবনকে বিষিয়ে দেয়ার সমস্ত আয়োজন। ফেসবুকের অপব্যবহার কারা বেশি করে এধরণের জরিপ হলে আমরা নিঃসন্দেহে প্রথম হবো। ফেসবুকের পাতায় পাতায় তার সমালোচনা। কেন সে শ্রীমঙ্গলের মত পবিত্র যায়গায় করোনা নিয়ে আসলো। ভাব এমন যে করোনা এসে পবিত্রতা নষ্ট করে দিলো, আর তার দায়ভার আমার কলিগের।শহরের চৌমুহনীতে নিয়ে বিচারের দাবি তুললেন অনেকে। যেন সে ব্যক্তিগত কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। একটা শহর পবিত্র কিনা তা নির্ভর করে তার বাসিন্দারা কত পবিত্র তার উপর। শ্রীমঙ্গল শহরের এই বাসিন্দারা কি নিজেদের আর পবিত্র ভাবতে পারবেন?

আকিজ গ্রুপের হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ ভন্ডুল করে দিলেন এলাকাবাসী। সিলেটের এক এলাকার বাসিন্দারা সিভিল সার্জন বরাবর স্মারকলিপি দিলেন মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগী ভর্তি না করার দাবীতে। আচ্ছা, এখন শহীদ ডাঃ শামসুদ্দিন হাসপাতালের এলাকার লোকজন যদি একই দাবি তুলে? স্মারকলিপি দেয়া এলাকার কেউ যদি করোনা আক্রান্ত হন, আপনি চিকিৎসা কোথায় পাবেন? নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করার এই আয়োজন কেনো?

এটা কি এক এলাকার সমস্যা? সর্বত্র এই একই অবস্থা।

কোভিড-১৯ থেকে বাঁচার উপায় একটাই। ঘরে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। অপ্রয়োজনীয় বাইরে ঘুরাফেরা বন্ধ রাখা। আক্রান্ত হলে নিজেকে আইসোলেটেড রাখা। এইতো? তাহলে এই হামলা মারামারি আসছে কেন?

আমরা অতি সচেতন জাতি। সচেতন ভাবে সচেতনতার সব উদ্যোগ আমরা ভেস্তে দিচ্ছি। আমরা ঘরে থাকছি না।সামাজিক দূরত্ব মানছি না। লকডাউন করা রাস্তায় ইফতারের বাজার বসাচ্ছি, দোকানের শাটার ফেলে রেখে পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করছি, আক্রান্ত হলে ডাক্তারের কাছে লুকিয়ে রাখছি।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স) বলেছেন মহামারি হলে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করতে। আমরা তার বিপরীতে।নারায়ণগঞ্জ আর ঢাকা থেকে ভাইরাসকে দেশের সর্বত্র পৌছে দেয়ার মহান দায়িত্ব আমরা যত্নের সাথে পালন করছি। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স) বিরূপ পরিস্থিতিতে নিজ ঘরে নামাজ আদায় করতে বলেছেন।আমাদের আলেমগণ, সরকার সবাই বারবার আবেদন জানিয়েও এটা করা যাচ্ছে না। আমাদের সিজনাল নামাজীরা মসজিদের ইজ্জত রক্ষায় সোচ্চার। মসজিদের সৌন্দর্য এর নামাজী। সংখ্যায় নয়, গুনগত মানের নামাজী। আমরা সংখ্যাতত্ত্বে বিশ্বাসী। মক্কার কাবাঘর শূন্য রেখে আমরা পাড়ার মসজিদ পূর্ণ করার ঈমানী শক্তি দেখাতে তৎপর। মসজিদে নামাজ পড়তে না পারলে এলাকার ঘরে ঘরে ১৫-২০ জন মিলে জামাত করছেন। অথচ জুম্মা ছাড়া বাকি দিনগুলোতে আমাদের মসজিদগুলো জনশূন্য থাকে।আফসোস।

করোনা যখন বাংলাদেশে আসেনি সেই সময় একদিন একজনের সাথে এ নিয়ে কথা হচ্ছিলো। উনি যুক্তি দেখালেন করোনা আমাদের দেশে কিছু করতে পারবে না। কারণ আমাদের দেশ উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের, আর দ্বিতীয়ত আমাদের দেশের মানুষের ঈমানি শক্তি অনেক বেশি তাই। উনাকে বলেছিলাম প্রায় শতভাগ চোর বাটপার দূর্ণীতিবাজের দেশে ঈমানি শক্তি কিভাবে বাঁচাবে? করোনা হানা দিয়ে দেখিয়ে দিলো কেবল চুরি বাটপারি নয়, মানবিক দিক দিয়েও আমরা কত নিচু স্তরের। মায়ের করোনা হয়ে থাকতে পারে এই আশংকায় তাঁকে জংগলে ফেলে যায় সন্তানেরা, মারা যাওয়া করোনা রোগী দাফনের জায়গা পায়না, মসজিদের খাটিয়া পায়না, আমলদার ইমাম জানাযা পড়ান না, সন্তান অভিভাবকের মৃতদেহ ফেলে রাখে, সন্তানের মৃতদেহ বাসার গেটে ফেলে রাখেন অভিভাবক। আমরা বড়াই করি ঈমানি শক্তির!

ঈমান কেবল মসজিদে নামাজ পড়লেই শক্ত হয় না। কেবল নামাজ পড়েই মুসলমান হওয়া যায় না। ধর্ম কেবল মন্দিরের চারদেয়ালে থেমে থাকেনা। জীবনযাপনে যদি ধর্মকে ধারণ না করতে পারলেন, মনের পশু মারতে না পারলেন, তবে আর নামাজ পড়ার কষ্ট কেনো?