একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর সেনানী; কুলাউড়ার ফুটবলের সত্যিকারের বীর পুরুষ প্রয়াত আব্দুল মুকিত মিকি
- আপডেটের সময় : ১১:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২০
- / ৩৫০ টাইম ভিউ
একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর সেনানী; কুলাউড়ার ফুটবলের সত্যিকারের বীর পুরুষ প্রয়াত আব্দুল মুকিত মিকি
আহসানুজ্জামান রাসেল
একজন ফুটবলারকে তার ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন যে জিনিস তা হলো শারীরিক ফিটনেস। আপনি যত ভালো ফুটবলার হোন না কেন শরীর ফিট না থাকলে আপনার ভবিষ্যৎ কিন্তু অন্ধকার। কুলাউড়ার ফুটবল ইতিহাসে শারীরিক ফিটনেসের দিক দিয়ে আব্দুল মুকিত মিকির সমতুল্য ফুটবলার আর কেউ নেই বললেই চলে। সুঠাম দেহের অধিকারী, লম্বা চওড়া কিন্তু অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার একজন ফুটবলার ছিলেন প্রয়াত আব্দুল মুকিত মিকি। স্বাধীনতা উত্তর কুলাউড়ার ফুটবলের একটা ।প্রজন্মকে নেতৃত্ব দানকারী এই কৃতি ফুটবলারকে আজকে নতুন প্রজন্মের কাছে তোলে ধরার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
কুলাউড়া পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত সোনাপুর গ্রামে আব্দুল মুকিত মিকির বাড়ী। উনার জন্ম ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির বছরে। বাবা মৃত সুরুজ উল্লাহ পঞ্চায়েতের প্রধান বিচারক ছিলেন। সুরুজ উল্লাহর তিন ছেলে এবং এক মেয়ের মধ্যে মিকি চাচার অবস্থান দ্বিতীয়। ফুটবল খেলা শুরু করেছেন ঐতিহ্যবাহী নবীন চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায়।
তৎকালীন সময়ে উনার খেলোয়াড় জীবনের সহপাঠী কুলাউড়ার খেলাধুলার ইতিহাসের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব আবুল ফাত্তাহ ফজলু স্যার স্মৃতিচারণে বলেন ” মিকি আমার সহপাঠি, আমরা হাইস্কুলে পড়াকালীন ফুটবল খেলা শুরু করি। ১৯৭০ সালে প্রথম আমরা এন সি স্কুল টিমে অন্তর্ভূক্ত হই। সবার নাম স্মরণে নেই, তবে সহপাঠিদের মধ্যে মিকি, ফয়সল (কাছুর কাপনের শওকতের বড় ভাই), প্রয়াত গিয়াস (মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার), হিফজুল (শিক্ষক), মছু ভাই, আমি সহ আরো কয়েকজন ছিলাম। এ বছর আমরা মৌলভীবাজার মহকুমা চ্যাম্পিয়ান হয়ে সিলেট জেলা হাইস্কুল প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। সেখানে রাজা জি সি হাইস্কুলের সাথে খেলা হয়। আমরা এক গোলে এগিয়ে যাবার সাথে সাথে ওরা মারামারি শুরু করে। মিকি ও ফয়সল আহত হয়। খেলা ড্রতে গড়ায়। পেনাল্টি কিক শুরু হলে ওরা গোলকিপারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, পরিণামে আমরা পরাজিত হই। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে মিকি ও গিয়াস মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেয়। কুলাউড়া মুক্ত হলে তারা বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন করে। গিয়াস খেলাধুলা বাদ দিলেও মিকি পুরোদমে খেলাধুলায় ফিরে আসে। ৭২ থেকে ফুটবল ও ভলিবল খেলা আবার শুরু করে, পরবর্তীতে ক্রিকেটে, এ্যাথলেটিক্সেও ভাল ছিল। ১৯৭৩ সালে কুলাউড়া কলেজে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হাই জাম্পে মিকি প্রথম এবং আমি দ্বিতীয় আর লং জাম্পে আমি প্রথম এবং মিকি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। বর্ণিল খেলোয়াড় জীবনে অনেক জায়গায় ফুটবল খেলেছে। সে ছিল খুব ঠান্ডা মাথার একজন পরিচ্ছন্ন ফুটবলার। তার মত এত লম্বা থ্রো আমাদের মধ্যে অন্য কেউ করতে পারতো না। ভালো উচ্চতা, ফিট বডি, ড্যাসিংএ ক্লাস ওয়ান, কারোর পক্ষে টক্কর দেয়া সহজ ছিল না। খুব ভালো হেড করতো, বিশেষ করে কর্ণার কিকে উড়ন্ত হেডে গোল করায় খুব দক্ষ ছিলো। খেলায় হাতা-হাতি, মারামারি হলে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতো। অন্যের মার নিজে হজম করে নিত কিন্তু কারো শরীরে হাত তোলাতো দূরের কথা কটু কথা পর্যন্ত বলতো না। টিমকে নেতৃত্ব দেয়ার সকল গুণাবলী তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। মিকিকে নিয়ে কত আনন্দ বেদনার স্মৃতি গেঁথে আছে মনে। আমাদের সবাইকে ছেড়ে বড় অসময়ে চলে গেল সে।”
ফজলু স্যারের এরকম হৃদয়স্পর্শী সৃত্মিচারণের পর মিকি চাচা কেমন মানুষ ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তিনি বিভিন্ন সময় যেসব দলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন তার মধ্যে অন্যতম-
১. এনসি উচ্চ বিদ্যালয় টিম
২. সমস্বর যুব সংঘ, কুলাউড়া
৩. কুলাউড়া একাদশ
৪. বৈখালী ক্লাব, শ্রীমঙ্গল
৫. ওয়ান্ডার্স ক্লাব, মৌলভীবাজার
৬. মোহামেডান স্পোর্টিং, মৌলভীবাজার
৭. ইলেভেন স্টার, মৌলভীবাজার
৮. বনানী ক্লাব, বিয়ানীবাজার
৯. কাজীটুলা স্পোর্টিং, সিলেট
কুলাউড়া ডিগ্রি কলেজ ছাত্র সংসদের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত জিএস ছিলেন আব্দুল মুকিত মিকি। এছাড়া তৎকালীন কুলাউড়া ইউনিয়ন পরিষদেরও একবার নির্বাচিত মেম্বার ছিলেন তিনি। উপজেলা পর্যায়ে খেলাধুলার অভিভাবক সংগঠন হলো উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা। আমাদের অনেকেরই আজানা, পদাধিকার বলে এই সংগঠনের সভাপতি সবসময় টিএনও এবং সাধারণ সম্পাদক সহ বাকী পদগুলো স্থানীয়দের মধ্য থেকে করা হয়। ১৯৮৪ সালে কুলাউড়া উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা প্রতিষ্ঠা হবার পর প্রথম সভাপতি হোন তৎকালীন টিএনও সিরাজুল ইসলাম আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হোন আব্দুল মুকিত মিকি এবং তিনি অত্যন্ত সফলভাবে উনার মেয়াদ সম্পন্ন করেন।
আব্দুল মুকিত মিকির খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক শ্রদ্ধেয় এনামুল ইসলাম এনাম মুখে শুনুন “মিকি একাধারে ফুটবল, ক্রিকেট এবং ভালো ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন। খেলোয়াড়ী জীবনের পর বহু গুরুত্বপূর্ণ ফুটবল ম্যাচে তিনি রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধুবর মিকি ভলিবল ও ক্রিকেট খেলাও পরিচালনা করতেন। তিনি দর্পন নাট্যগোষ্ঠীর কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছেন। সমস্বরের সভাপতি ও চক্ষুশিবিরের নিবেদিত গপ্রাণ সদস্য ছিলেন। সকল অনিয়ম, অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সব সময় এক সোচ্ছার কন্ঠস্বর ছিলো আব্দুল মুকিত মিকি। মৃত্যুর ৩/৪ বছর আগে প্রায় প্রতিদিন আছরের নামাজ উত্তর বাজার মসজিদে পড়ে আমার ফার্মেসীতে এসে বসতেন, মাগরিব পর্যন্ত পেপার পড়তেন, আযান হলে নামাজে চলে যেতেন। যেদিন মারা যান — অসুস্থতার খবর পেয়ে ডাঃ অমিতাভ ও ডাঃ সরোয়ার সহ উপস্থিত হই মিকির বাড়ীতে, গিয়ে দেখি ভাবী ও আত্মীয়স্বজন পা ও বুকে তেল মালিশ করছেন। অমিতাভ আমার কানে কানে বলার পর আমি চাদর টেনে বন্ধুর নিথর দেহ ঢেকে দেই। তখনই কান্নার রোল উঠে বাড়ীতে। এভাবে আমার একজন ভালো বন্ধু এবং কুলাউড়ার জন মানুষের একজন বন্ধু চির বিদায় নেন”।
আসলে অনেকটা আকস্মিক ভাবেই ২০০২ সালের ২৫শে এপ্রিল হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার কারনে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চির বিদায় নেন কুলাউড়ার ফুটবলের বীর পুরুষ আব্দুল মুকিত মিকি। উনার তিন ছেলে মিতুল, রানা এবং রাজ্জাক যাদের শরীরে মিকি চাচার রক্ত প্রবাহমান তারাও ফুটবলকে অসম্ভব ভালোবাসে, বিশেষ করে বড় ছেলে কুয়েত প্রবাসী মিতুল,৮বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কুলাউড়ার ফুটবলের জন্য কিছু একটা করতে চায়। মিকি চাচার সহধর্মিণী রাবেয়া বেগম কুলাউড়া পৌরসভার স্বনামধন্য মহিলা কাউন্সিলর, যিনি টানা তিনবার পৌরসভার ১,২ এবং ৩ নং ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। মিকি চাচার মতো আরেকজন সৎ, নিরহংকার, নির্লোভ এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্বর দেখা কুলাউড়া কবে পাবে তা সময়ই বলে দিবে। আমরা শুধু চাচার আত্মার শান্তির জন্য দোয়া করছি এবং উনার পরিবারের সবার সুস্বাস্থ্য এবং মঙ্গল কামনা করছি।