অদম্য স্পৃহার এক যুবকের গল্প: শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকেও হার মানিয়ে আফজাল এখন সমাজের বোঝা নয় ভরসা
- আপডেটের সময় : ০৮:৫৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অগাস্ট ২০১৯
- / ৯৬৭ টাইম ভিউ
এস আলম সুমনঃ জন্ম থেকে দুটি হাত বিকলাঙ্গ (প্রতিবন্ধী) আফজল হোসেনের (৩৫)। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে নিজের আত্মবিশ্বাসেই নিজ পায়ে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
প্রতিবন্ধী হলেও তিনি কখনো অন্যের ওপর ভরসা করেননি বরং পড়লেখা করেছেন নিজের অদম্য স্পৃহা দিয়ে। শত উপক্ষোয় কখনো নিজে ভেঙ্গে পড়েননি।
পড়ালেখা শেষে নিজেই ফার্মেসী ব্যবসার পাশাপাশি মোবাইল রিচার্জ ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ৯ বছর ধরে। আফজাল আজ সমাজের বোঝা নয় ভরসার প্রতীক হয়ে দাঁড়িছেন স্থানীয় এলাকাবাসীর কাছে।
আফজাল মৌলভীবাজারের কর্মধা ইউনিয়নের পাট্টাই গ্রামের মৃত ক্বারী আব্দুল লতিফের পুত্র। আফজাল তাঁরা ৪ভাই ও ২ বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি তৃত্বীয়। বর্তমানে কর্মধার কাঠালতলী বাজারে একটি ফার্মেসী স্বত্বাধিকারী।
সরেজমিনে কাঠালতলী বাজারে গিয়ে দেখা যায় আফজাল তাঁর নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে একাই রোগীদের চিকিৎসকের ব্যভস্থাপত্রনুযায়ী ঔষধ দিচ্ছেন। বিকালঙ্গ হাত দিয়ে নিজেই দিব্যি মোবাইল রিচার্জ ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করতে আসা গ্রাহকদের মোবাইল রিচার্জ এবং বিকাশ পেমেন্ট করে দিচ্ছেন।
এসময় তিনি বলেন, ২০০০ সালে কর্মধা টাইটেল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন। পরে ভর্তি হোন সিলেট খাস্দবির দারুসসালাম আলীম মাদ্রাসায়। সেখান থেকে পড়ালেখা আলীম পাস করে বিশ্বনাথ মাদানীয়া টাইটেল মাদ্রসায় ভর্তি হোন। ২০০ সালে ফাজিল ও ২০০৬ সালে কামিল (টাইটেল- মাস্টার্স সমমান) পাস করেন। এরপর ঢাকার যাত্রবাড়ীতে অবিস্থিত মাদ্রসা শিক্ষক ট্রেনিং সেন্টার থেকে শিক্ষক নিবন্ধন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর আবার সিলেটে একটি মাদ্রসায় ৬ মাস শিক্ষকতা করেন। মা ফজিুরুন বেগমের অনুপ্রেরণায় ও ভাইদের সহযোগিতায় নিজের অদম্য স্পৃহায় শারীরিক প্রতবিন্ধকতাকে হার মানিয়ে তিনি সফলভাবে পড়াশুনা শেষ করেছেন। ২০১০ সালে নিজ এলাকায় এসে কাঠালতলীবাজারের একটি মার্কেটে দোকান কোঠা ভাড়া নিয়ে মডার্ণ ফার্মেসী নামে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন। বর্তমানে ফার্মেসী ব্যবসার পাশাপাশি মোবাইল রিচার্জ ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছেন। পার্মেসী ব্যবসার সুবাদে এলাকার মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন। গভীর রাত কিংবা ঝড় বৃষ্টির সময় এলাকার কোন মানুষ অসুস্থ হলে তখন আফজালই হয়ে ওঠেন এলাকাবাসীর ভরসা।
আফজাল বলেন, ‘ছোটকাল থেকেই শারীরিক প্রদিবন্ধকতা নিয়ে অনেক উপেক্ষা সইতে হয়েছে। বাবা মারা যান অনেক বছর আগে। তখন আমার মা ই আমাকে অনুপ্রেরণা দিতেন। মায়ের অনুপ্রেরণায় ও নিজের আত্মবিশ্বাসে কর্মধা টাইটেল মাদ্রাসা থেকে পড়াশুনা শেষ করে প্রথমে সিলেটের খাসদবি মাদ্রসায় ও পরে বিশ্বনাথ মাদানীয়া মাদ্রসা থেকে টাইটেল পাশ করেছি। সিলেট ও বিশ্বনাথে পড়াশুনার সময় অনেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধীকতা থাকায় আমাকে লজিং (গৃহশিক্ষক) রাখতে চাইতেননা। তবুও আমি আত্মবিশ্বাস হারাইনি। পরে বিশ্বনাথে একজন লোকের সহযোগিতায় আমি উনার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করেছি। কিছুদিন সিলেটের শিববাড়ি এলাকার একটি মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছি। পরে এলাকা চলে আসি। এলাকায় এসে এখানে দোকান ভাড়া নিয়ে ফার্মেসী ব্যবসা চালু করি। এর সাথে বিকাশ ও মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসা চালু করি।’
তিনি আরো বলেন, ‘গভীর রাতে এলাকার কোন শিশু ও বয়োবৃদ্ধ কেউ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে এলাকার লোকজন আমাকে ডেকে নেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দূরে থাকায় অনেকসময় কেউ দুর্ঘটনায় আহত হলে সেখানে যেতে পারেননা। তখন আমি তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেই। এলাকার লোক অসুস্থ হলে প্রথমেই আমার ওপর তারা ভরসা করেন।,
তিনি বলেন, আমার হাত দুটি বিকলাঙ্গ তবুও আমি আমার আত্মবিশ্বাস হারাইনি। নিজে কর্ম করে চলছি। আমি এখনো বিয়ে করিনি। আমার দুই ভাই প্রবাসে থাকেন। ছোট ভাই সস্থানীয় একটি ব্যাংকের স্বনির্ভর প্রকল্পে চাকুরি করছে। আমা ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি পরিবারের সকল দায়িত্ব পালন করে থাকি। আমি কখনো সমাজের অন্য লোকের ওপর নির্ভর করিনি। আমার অবস্থান থেকে এলাকার মানুষের সেবা করা এটাই আমার স্বপ্ন।’
স্থানয় এলাকাবাসী মকবুল আলী ও সাহেল আহমদ বলেন,‘আফজাল নিজের চেষ্টায় শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও সে নিজে প্রতিষ্ঠিত। এলাকার কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে কিংবা আহত হলে তিনি সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। গভীর রাত হলেও এলাকার কেউ অসুস্থ হলে তাঁকে জানালে তিনি দ্রুত তাদের সহযোগিতা এগিয়ে আসেন। এখন তিনি সমাজের বোঝা নন। তিনি এলাকার মানুষের আস্থা ও ভরসার প্রতীক।’
কর্মধা ইউপি চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান আতিক বলেন, ‘শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্তে¦ও আফজাল নিজের আত্মবিশ্বাস ও নিজ চেষ্টায় সে পড়াশুনা করে বর্তমানে স্থানীয় কাঠালতলী বাজারে ফার্মেসী ব্যবসা পরিচালনা করছে। এলাকার কেউ অসুস্থ এমন খবর পেলে সে ছুটে যায় ওই রোগীর বাড়িতে। এলাকার মানুষের কাচে কাছে সে এখন ভরসার প্রতীক। এমন যুবক তরুণ সমাজের কাছে আদর্শ হতে পারে।প্রতিবন্ধী হওয়ায় আমারা তাঁকে ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছি।’